মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস
পুরান ঢাকায় অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
মৃত্যুঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছে ঢাকার লাখ লাখ মানুষ। কারণ এলাকায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। সরেজমিন রোববার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ থেকে ২৫০ বছরের পুরনো সব বাড়ি। পলেস্তরা খসে পড়েছে। অনেক বাড়িতে বাঁশ দিয়ে ছাদ ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। দেখলে মনে হয়, জোরে বাতাস উঠলেই বুঝি ভেঙে পড়বে। পড়েছিলও। ২০০৪ সালের ৯ জুন শাঁখারীবাজারে একটি ভবন ধসে ১৯ জন মারা গিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটছে।
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার এলাকায় তিন ভবনে মারাত্মক ফাটল দেখা দেয়। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় বাড়িওয়ালাসহ বাসিন্দাদের নামিয়ে দেয় পুলিশ। ৯৯/১ এবং পাশের ১০১ ও ১০৩ নম্বর ভবনে এ ফাটল দেখা দেয়। বিভিন্ন সময় সরকার চেয়েছে বাড়িগুলো ভেঙে নতুন করে বাড়ি বানাতে, কিন্তু পরে সে উদ্যোগের আর বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস করছে পুরান ঢাকার লাখ লাখ মানুষ।
ভবন ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এর আগেও তাঁতীবাজারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের পলেস্তরা খসে সাত ছাত্র আহত হয়। ২০০৪ সালের শাঁখারীবাজারে ট্র্যাজেডির পর সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। ডিসিসির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ইদ্রিস মইনকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটি ৬৮৭টি ভবনকে চিহ্নিত করেছিল। সেগুলো ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকে বলেছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। জানা যায়, ডিসিসির অধ্যাদেশ-১৯৮৩ অনুযায়ী ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার দায়িত্ব ডিসিসির। কিন্তু ডিসিসি পুরনো ভবন ভাঙার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ কখনোই নেয়নি। তবে ডিএনসিসির প্রশাসক মোঃ ফারুক জলিল বলেন, এ বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার কাজে আঞ্চলিক বিভাগ থেকে তদারকি করছে। তিনি বলেন, এ কাজে রাজউকেরও দায়িত্ব আছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরে সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ ভবন চিহ্নিত করতে সার্ভে করার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পুরান ঢাকার ভবনগুলোতে সার্ভে চালানো হচ্ছে। যেগুলো খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো ভেঙে ফেলবে ডিসিসি। রাজউকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের কোনো তালিকা রাজউকের নেই। নিয়ম হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার কাজ করবে ঢাকা সিটি করপোরেশন। কিন্তু রাজউক কীভাবে দায় এড়াতে পারে_ এমন প্রশ্ন করতেই ওই কর্মকর্তা বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাজউকের পক্ষে সার্ভে করা সম্ভব নয়। ভবন তৈরির বিষয়টি দেখবে রাজউক, আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার দায়িত্ব ডিসিসির। তবে সরকার বাড়িগুলো নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা করলেও বাড়ির মালিকরা চান না, তাদের বাড়ি ভাঙা হোক। তারা বলছেন ঝুঁকি নিয়ে থাকবেন, চাপা পড়ে মারা যাবেন, তবু বাড়ি ভাঙার পক্ষে তারা নন। শাঁখারীবাজারের ৮৫ নম্বর প্লটের মালিকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তিনি বেরিয়ে আসেন। বয়োবৃদ্ধ মানুষটি নিজের নাম বলতে চান না। তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়েই আমরা আমাদের ভিটামাটিতে থাকতে চাই। বহু লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু আমরা সরকারকে দিয়ে বাড়ি ভেঙে নতুন করে বাড়ি বানানোর কথায় রাজি হইনি। আমরা বরাবরই বলে আসছি, আমাদের সরকারি সাহায্যের দরকার নেই। আমাদের বাড়ি আমরাই মেরামত করতে পারব। ভূমিকম্প হলে তো মারা যাবেন_ এমন উক্তি করতেই বলেন, মারা গেলে মারা যাব, কিছু করার নেই। আমরা যদি মেরামত করতে না পারি, তবে চাপা পড়ে মরে থাকতে রাজি আছি। তবু সরকারকে বাড়ি দেব না। নিজের ভাঙা তিনতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, আমার এ বাড়ির দাম ১ কোটি টাকা। এ বাড়ি ভেঙে যদি আমি আবার তিনতলা তুলতে যাই, সরকার কি দেবে এত টাকা? পুরান ঢাকার সবচেয়ে ভঙ্গুর ভবনগুলো আছে শাঁখারীবাজারে। এখানে মোট ১৪২টি বাড়ি আছে। এর মধ্যে ৯১টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক বাড়ি আছে, যার তিনতলায় কোনো ছাদ নেই। পলিথিন শিট দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়েছে। বাঁশ দিয়ে পিলারের কাজ চালানো হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ভবনের মালিকরা হাইকোর্টে মামলা করেছিল। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি।