শনিবার সিলেট স্টেডিয়ামে চলছিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল) ২১তম ম্যাচ। মাঠের লড়াইয়ে
রংপুর রাইডার্স ও সিলেট সিক্সার্স। ১৯তম ওভারের খেলায় ম্যাচের জয়-পরাজয় নিশ্চিতের লড়াই চলছে। টান টান উত্তেজনা দুই পক্ষের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মাঝে। এর চেয়ে ঢের উত্তেজনা বাজিকরদের মাঝে। কাওরান বাজারের একটি চায়ের দোকানে ওই ওভারে ৮ রান হবে বলে সহকর্মী বাবুল মিয়ার সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন আল আমিন। বাবুল মিয়া বলছিলেন ১৫ রানের বেশি হবে।
আল আমিন বলেছিলেন সর্বোচ্চ আট রান।
যে জিতবে পাবেন ৫ হাজার টাকা। ওভার শেষে বাজিতে জিতে বাবুল হাতে পান ৫ হাজার টাকা। শুধু বাবুল বা আল আমিনই নন বিপিএল নিয়ে মাঠের বাইরে এমন বাজিতে মজছেন বহু মানুষ। ক্রিকেট জুয়ায় জড়ানোর অভিযোগ আছে খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধেও। খেলার বাইরে এই অনৈতিক বাজি ঠেকাতে তৎপর বিপিএল কর্তৃপক্ষও। তাদের কর্মীরা চোখ রাখছেন গ্যালারিতে। মাঠে বসে জুয়া খেলারত অবস্থায় ২৪টি ম্যাচে ৪৫ জনকে আটক করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাদের মধ্যে ২০ জন বিদেশি নাগরিক। এছাড়া নেট দুনিয়ায় বাজি ধরা হয় এমন ১২টি সাইট বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি।
যদিও এসব সাইটের বেশির ভাগই প্রক্সি সার্ভারে চালাচ্ছে জুয়াড়িরা। বিপিএল নিয়ে বছর বছর বাড়ছে বাজিকরদের তৎপরতা। গতবছর ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাজি ধরে ঢাকার বাড্ডায় এক শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে জুয়াড়িদের ফাঁদে পড়ে স্পট ফিক্সিংয়ে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল। খেলা ঘিরে ছোট-বড় চায়ের দোকান, শহরের অলিগলি, ক্লাব, বার, এমনকি পাঁচ তারকা হোটেলে বসে বাজির আসর। বিপিএলের একেকটি ম্যাচে কোটি কোটি টাকার বাজি ধরা হচ্ছে।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসাবো এলাকার একটি সিএনজি অটো রিকশার গ্যারেজে সন্ধ্যার পর থেকে জড়ো হন চালকরা। সেখানে সবাই মিলে বিপিএল এর ম্যাচ দেখেন। আড্ডা আলোচনার সঙ্গে ওভারে ওভারে চলে জমজমাট বাজি। প্রতি বাজিতে একশ থেকে পাঁচ শ’ টাকা লেনদেন হয়।
সেখানে বাজি ধরেন এমন একজন আবুল হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরেই বিপিএল খেলা নিয়ে আমরা বাজি খেলি। সারা দিন কাজ করে অবসর সময়ে এখানে বসে আড্ডার ফাঁকেই চলে বাজি। কেউ হারে কেউ জিতে। এখানে আমরা সবাই চালক। বাইরের কেউ আসে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বিপিএলে বিদেশি তারকা খেলোড়ারের ছড়াছড়ি। তাই প্রথম ম্যাচ থেকেই বাজিকররা একটু বেশিই মেতেছেন। ভারত-পাকিস্তানের জুয়াড়িরা প্রথম থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বিপিএলকে সামনে রেখে অন্তত পাঁচ শতাধিক বিদেশি জুয়াড়ি দেশে অবস্থান করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। ৫ই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিপিএলের প্রথম তিন দিনে মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে ২০ জন জুয়াড়িকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে চার হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
ক্রিকেট বাজিতে জড়িত এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে নানা তথ্য। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বলেন, বাজি খেলাটা মূলত প্রথম স্কুল জীবনে শুরু হয় নিজেদের ক্রিকেট খেলা থেকে। দুই দল যখন ক্রিকেট খেলতো তখন বন্ধুরা মিলে বাজি ধরতাম। এভাবেই ধীরে ধীরে এই লাইনে আসা। এখন বাজি ধরাটা যেন নেশায় পরিণত হয়েছে। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাজি ছেড়ে দেবো। কিন্তু বাজিকরদের ফোন আসায় আবার সেই ধারায় চলে যেতে হয়। একবার মেস ছেড়েছিলাম যাতে আর বাজি খেলতে না হয়। কিন্তু নতুন মেসে যেয়েও জড়িয়ে পড়ি বাজিতে। বাজি খেলে লাভ হয় কিনা জানতে চাইলে আরেকজন বলেন, দুইজন যেহেতু খেলছি লাভ লসতো হবেই। তবে লাভের টাকার ভাগিদার বেশি হয়। আর লাভের টাকা যতই বেশি হোক না কেন কোনো না কোনো ভাবে তা খরচ হয়ে যায়। আরেকজন আক্ষেপ করে বলেন, বাজির টাকায় আমার কেনা মোটরবাইক হয়েছে চুরি।
ল্যাপটপ কিনলাম সেটা বিক্রি করে হারা ম্যাচের টাকা পরিশোধ করলাম। বিপিএল সূত্রে জানা গেছে, এবারের বিপিএলে মাঠের ভেতরের জুয়াড়িদের রুখতে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। কারণ, জুয়াড়িদের বেপরোয়া আচরণে অনেকটা অস্বস্তিতে আছে বিপিএল কর্তৃপক্ষ। তাই এই টুর্নামেন্টের অন্য দিকগুলোর মতো জুয়া ও জুয়াড়ি ঠেকানোতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পোশাকে ও সাদা পোশাকে দুর্নীতি দমন ইউনিটের সদস্যরা কাজ করছেন। এ ছাড়া খেলা চলাকালীন ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘুরে বেড়ায় গ্যালারিতে। দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা দর্শকদের সন্দেহভাজন হিসাবে আটক করা হচ্ছে। যাচাই বাছাই করে যদি জুয়ার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে কোনো খেলোয়াড় যাতে স্পট ফিক্সিংয়ে না জড়ায় সেদিকে বাড়তি নজরদারি রয়েছে।
খেলোড়ারদের হোটেল রুম, ড্রেসিং রুম, এমনকি মাঠেও যাতে কোনো জুয়াড়ি তাদেরকে প্রভাবিত করতে না পারে তার জন্য আলাদা আলাদা টিম কাজ করছেন। সব মিলিয়ে বিপিএলে বাজি রুখতে অন্তত সহস্রাধিক সদস্য কাজ করছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের গভর্নিং কাউন্সিলিংয়ের সদস্য সচিব ইসমাঈল হায়দার চৌধুরী বলেন, বিপিএল জুয়া ও স্পট ফিক্সিং নিয়ে আমাদের অবস্থান খুবই স্ট্রিট। এসব কারণে আমরা এক বছর খেলা বন্ধ রেখেছি। এ বছর সিভিল ও ফরমাল পোশাকে প্রায় ১ হাজার কর্মী বাজি প্রতিরোধে কাজ করছে। হোটেল রুম থেকে শুরু করে, ড্রেসিং রুম, মাঠের ভেতরে নজরদারি চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি জুয়াড়িকে আটক করা হয়েছে। যাদেরকে আটক করা হচ্ছে সঙ্গে তাদের জরিমানা করে থানায় নেয়া হচ্ছে। অনেককে জেলে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, আইনে আছে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ৮/১০ দিনের জেল ও জরিমানা করা যাবে। পাশাপাশি আটক বিদেশিদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে বিপিএল বাজি বন্ধ করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন ইউনিট ১২টি বিদেশি বেটিং সাইট বাংলাদেশে বন্ধের জন্য চিঠি দিয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও নিরাপত্তা বিভাগকে। সাইবার ক্রাইম ইউনিট সেসব সাইট বন্ধের জন্য চিঠি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অবগত করেছে। ইতিমধ্যে সেসব সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করা সাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে বেটিং সাইট রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, সাইট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম। এদের মধ্যে বেটিং সাইট ৩৬৫ ডটকম যেকোনো ধরনের খেলার বাজির জন্য জনপ্রিয়। বিশ্বের ২০০টি দেশের ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি বাজিকর নিয়মিত এই সাইট ব্যবহার করেন। তবে বাংলাদেশে এসব সাইট বন্ধ করে দেয়ার পরও থেমে নাই জুয়াড়িরা। ভিপিএন, প্রক্সি সার্ভার ও অ্যাপ দিয়ে তারা এই সাইটগুলো ব্যবহার করছেন।
লেনদেনের জন্য তারা ব্যাংক থেকে শুরু করে পেপাল, পেওনিয়ার, মাস্টার, ডেবিট ও ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের অনলাইনভিত্তিক কার্ড ও ক্রিপকারেন্সিতে লেনদেন চলছে। বিশ্বের প্রায় ২৮টি দেশের মুদ্রায় তাদের লেনদেন হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও নিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রক্সির মাধ্যমে যদি জুয়া খেলে এগুলো আটকানোর পথ তেমন একটা নাই। এই দিকে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো আটকানোর জন্য বিপিএলের আলাদা একটি কমিটি রয়েছে। তারাই এগুলো দেখভাল করবে। তারপরেও তারা চাইলে পুলিশ তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু বিপিএল কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।
মোবাইলে, ম্যাসেঞ্জারে ও সরাসরি অনেকে জুয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এবারে আসর চলাকালে এ ধরনের অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাঠের বাইরে জুয়া চলে ঠিক। কিন্তু মাঠে ম্যাচ চলাকালীনও অনেক জুয়ার কার্যক্রম চলে। এগুলো বের করা উচিত বিপিএল কমিটির। এর সঙ্গে পুলিশের এটা টিমও কাজ করলে ভালো হতো। পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, শুধু জুয়া নয় যেকোনো ধরনের অপরাধ রোধে পুলিশ বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। বিপিএল নিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে জুয়া চলছে বলে আমরা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এ নিয়ে কাজ করছে। যদি কাউকে হাতেনাতে আটক করা যায় তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, এটি একটি মানসিক ব্যাধি। তাই এটি প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সমাজ বিজ্ঞানী নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, যারা বাজি ধরে এটা তাদের রুচির বিষয়। তাদের কাছে হয়তো এত অর্থ আছে খরচ করার জায়গা পাচ্ছে না তাই বাজি ধরে খরচ করে। বাজি ধরার মূল উপাদান টাকা। যার টাকা আছে সে বাজি ধরবে। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে। একসময় আমাদের দেশে যারা ডাংগুলি খেলত তারাই এখন পোল খেলে। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, উন্নত দেশে যেভাবে বৈধভাবে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা নাই। তাই চুরি করে অনেকেই জুয়া খেলছে। অনেকটা গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটকও করতে পারছেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন