রাজশাহীতে আলু চাষের মৌসুমে সারের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকরা সারের জন্য হাহাকার করছেন। কোথাও কোথাও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি বস্তায় ৪৫০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। বিএডিসির ডিলাররা নভেম্বর মাসে ডিএপি সারের কোনো বরাদ্দ পাননি। এর ফলে সারের চাহিদা মেটাতে বিসিআইসির ডিলারদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কৃষি বিভাগ ও বিএডিসির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তানোর, গোদাগাড়ী, বাগমারা ও দুর্গাপুরসহ রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় আলু চাষিরা সারের অভাবে জমি তৈরি ও বীজ রোপণ করতে পারছেন না। সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় প্রতি বস্তা সারে ৩৫০-৪৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হচ্ছে। স্থানীয় ডিলাররা অভিযোগ করেছেন, কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সারের বরাদ্দ নিয়ে অনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছেন। এসব নেতা একসঙ্গে ২০-৩০ বস্তা সার নিয়ে চাষিদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চাষিরা জানান, চাষি পর্যায়ে ৫০ কেজির এক বস্তা পটাশের সরকারি দাম ১ হাজার টাকা; কিন্তু রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে এক বস্তা চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা করে। অন্যদিকে চাষি পর্যায়ে এক বস্তা টিএসপির সরকারি দাম ১ হাজার ২৫০ টাকা; কিন্তু বর্তমানে এক বস্তা টিএসপি সার চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি বস্তায় চাষিদের অতিরিক্ত ৩৫০ টাকা গুণতে হচ্ছে। এদিকে ৫০ কেজির এক বস্তা ডিএপি সারের চাষি পর্যায়ে সরকারি দাম ১ হাজার ৫০ টাকা। তবে রাজশাহীর সর্বত্রই এই সার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা। ফলে এক বস্তা ডিএপি কিনতেই চাষিদের ৪৫০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
তানোরের চাষি লুৎফর রহমান জানান, রাজনৈতিক নেতারা ডিলারদের কাছ থেকে অধিকাংশ সার নিয়ে নিচ্ছেন। সেই সার তারা আবার বেশি দামে বিক্রি করছেন চাষিদের কাছে। পবার আলু চাষি মাহবুবুর রহমান জানান, বাজারে আলুর চড়া দামের কারণে এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। আলু বীজ সংকটের মধ্যে এবার চাষিদের সার কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না তারা।
এদিকে, গত ২২ নভেম্বর রাজশাহীর কামারগাঁও বাজারে বিসিআইসি সার ডিলার মৌসুমী ট্রেডার্সের দোকানে চাষিরা সার কিনতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা প্রভাব খাটিয়ে ট্রলিতে করে বিপুল পরিমাণ সার নিয়ে যান। অথচ সারের জন্য শতাধিক চাষি দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলেও চাষিরা কোনো সার পাননি। হতাশ চাষিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ডিলারের ম্যানেজার বিধান চন্দ্র দাসকে অবরুদ্ধ ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন। পরে ডিলার বিকাশ কুমার দাস নিজে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। শেষে চাষিদের এক বস্তা করে সার দিয়ে শান্ত করা হয়।
বিসিআইসির ডিলার বিকাশ কুমার দাস জানান, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। উপরন্তু প্রভাবশালীরা বেশি পরিমাণে সার নিতে চাপ দিচ্ছেন। অন্যদিকে বিএডিসির ডিলাররা অভিযোগ করেছেন, নভেম্বর মাসে ডিএপি সার বরাদ্দ পাননি তারা।
আলু চাষিদের অভিযোগ, কতিপয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কৃষি অফিসের কথা বলে ডিলারদের কাছ থেকে একসঙ্গে ২০-৩০ বস্তা করে সার নিয়ে যাচ্ছেন। ওই সার তারা বেশি দামে চাষিদের কাছে বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী শাখার সভাপতি আবু কালাম বলেন, কোনো কোনো দলের রাজনৈতিক কতিপয় নেতা ডিলারদের চাপ দিয়ে বেশি সার নিচ্ছেন বলে শুনেছি। তবে কোনো সংকট নেই। ডিসেম্বরের বরাদ্দও রবিবার নাগাদ পেয়ে যাব।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সার ডিলাররা বলছেন, চলতি নভেম্বর মাসে ডিএপি সার বরাদ্দ পাননি তারা। এ জন্য কৃষকদের চাহিদামতো সার দেওয়া সম্ভব হয়নি। ডিলারদের অভিযোগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা বিএডিসির সার ডিলারদের বাদ দিয়ে সার বরাদ্দ দিয়েছেন বিসিআইসি ডিলারদের। সেই সুযোগে বিসিআইসি ডিলাররা সিন্ডিকেট করে বাড়িয়েছে ডিএপি সারের দাম। বিসিআইসি ডিলারদের কাছে কৃষি কর্মকর্তা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিএডিসি ডিলারদের বঞ্চিত করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সুপারিশে ডিলারদের সার বরাদ্দ দেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক।
জানা গেছে, রাজশাহী জেলাজুড়ে বিসিআইসি অনুমোদিত ২১৯ জন সার ডিলার রয়েছেন। অন্যদিকে বিএডিসি অনুমোদিত ডিলারের সংখ্যা ১৩০ জন। বিসিআইসির এসব ডিলারের মাধ্যমে পটাশ, টিএসপি, ডিএপি ও ইউরিয়া সার বিতরণ করা হয়। তবে বিএডিসির ডিলাররা ইউরিয়া সার বরাদ্দ পায় না। বাকি তিনটি সার তারা বরাদ্দ পায় ও বিক্রি করে। যদিও বিএডিসি (সার) রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ মো. জুলফিকার আলী জানান, সারের কোনো সংকট নেই। গুদামে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এরই মধ্যে নভেম্বর মাসের বরাদ্দও ডিলারদের দেওয়া হয়ে গেছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে চারদিকে আলু চাষের হিড়িক পড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমি আলু চাষের আওতায় আসছে। মৌসুম শেষে ৩৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি আলু আবাদের আওতায় আসবে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের আশা। প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় আলু ফলনের এবারের লক্ষ্যমাত্রা সর্বোচ্চ।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, রাজশাহীর মোট ৩৪৮ জন ডিলারের মধ্যে চলতি নভেম্বর মাসে ২ হাজার ৮০৬ টন টিএসপি ও ৫ হাজার ৪৩২ টন এমওপি সার বরাদ্দ করা হয়েছে। এরই মধ্যে চলতি মাসের সব সারই উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এরপরও সারের সংকট কাটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, চলতি আলু আবাদে চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে কোথাও বিতরণে কোনো সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। সেটি আমরা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে মনিটরিং করছি। বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হলে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন