রাজধানীর হাটে ভরপুর গরু, ক্রেতারা কোথায়?
রাজধানীতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে বসা ২০টি গরুর হাটে পর্যাপ্ত সংখ্যক কোরবানির পশু উঠলেও এখন ক্রেতাদের দৃশ্যমান আনাগোনা নেই বললেই চলে। বিক্রেতারা বলছেন, দামাদামি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকছেন সবাই। ক্রেতাদের ভাষ্য, এখন পর্যন্ত গরুর দাম বেশি, অপেক্ষা করবেন কোরবানির শেষ রাত অবধি।
রাজধানীর বিভিন্ন গরুর হাট ঘুরে দেখা যায়, ঈদুল আজহা ঘনিয়ে এলেও ক্রেতারা এখন পর্যন্ত অনেকটাই নির্লিপ্ত। বিগত বছরের তুলনায় কোরবানি নিয়ে এবার রাজধানীর ক্রেতাদের মধ্যে উত্তেজনাও অনেক কম।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) উত্তরার দিয়াবাড়ি হাট ঘুরে দেখা যায়, হাটে পর্যাপ্ত গরু উঠলেও ব্যাপারিরা কাটাচ্ছেন অলস সময়। হাট কর্তৃপক্ষ জানায়, রাত থেকে হাটে গরুভর্তি ট্রাক এলেও এখনো ক্রেতাদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো না।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মনসুর ব্যাপারী বলেন, এবার হাটে তিনি ৩২টি গরু নিয়ে এসেছেন। এখন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি হয়নি। ক্রেতারা দাম জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছেন, আগেরবারের মতো দামাদামি পর্যন্ত করছেন না।
গত বছরের তুলনায় এ বছর গরুর দাম কেমন জানতে চাইলে মনসুর বলেন, এ বছর গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় গরুর দামও কিছুটা বেশি। তবে ব্যাপারীরা গরুর দাম অযৌক্তিক চাচ্ছে না বলে দাবি করেন।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে এবার ২০ জায়গায় বসেছে গরুর হাট। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে হাট সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
খিলগাঁও রেলগেট মৈত্রী সংঘ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, বনশ্রীর মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন খালি জায়গা, কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা, লালবাগে রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা এবং ডেমরার সারুলিয়ায় বড় আকারে গরুর হাট বসেছে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তরে উত্তরা দিয়াবাড়ি বউবাজার এলাকা, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশের খালি জায়গা, কাওলার শিয়ালডাঙ্গার এলাকা এবং ভাটারার সুতিভোলা খালের পাশের জায়গা, মোহাম্মদপুর বছিলা ৪০ ফুট রাস্তার পাশে, খিলক্ষেতের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়ার খালি জায়গা এবং ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাচকুড়া ব্যাপারীপাড়ার রহমাননগর আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা এবং গাবতলীতে স্থায়ী গরুর হাট বসেছে।
প্রাণী অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে, যার পুরোটাই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত। এর মধ্যে ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৭১৬টি গরু ও মহিষ, ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১টি ছাগল-ভেড়া ও ১ হাজার ৮৫০টি অন্যান্য পশু রয়েছে।
এ বছর মূলত কী সংখ্যক পশু কোরবানি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেছেন, ২০১৭ সাল থেকে বিগত বছর পর্যন্ত পরিসংখ্যান দেখলে প্রতিবছর ১ কোটির মতো পশু কোরবানি দেয়া হয়। সে হিসাবে এ বছর উদ্বৃত্ত কোরবানির পশুর সংখ্যা ৩০ লাখ। সব মিলিয়ে এ বছর ১ কোটি ৭ লাখের মতো পশু কোরবানি হতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিগত বছরে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও পশুর হাট থেকে বিক্রি হওয়া জবাইকৃত কোরবানির পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪২ হাজার। এর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু, ১ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫টি মহিষ, ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৮টি ছাগল, ৫ লাখ ২ হাজার ৩০৭টি ভেড়া এবং ১ হাজার ২৪২টি অন্যান্য পশু কোরবানি হয়েছে।
তবে এ বছর এখন পর্যন্ত ঢিমেতালে চলা বাজার প্রসঙ্গে, ব্যাপারীরা বলছেন মূল্যস্ফীতির বড় একটি প্রভাব পড়েছে কোরবানির হাটে। আগে হৈ-হুল্লোড় করে ক্রেতারা দলবেঁধে গরু কিনতে এলেও এবার সেই উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই দাম কমার জন্য শেষ দিনের অপেক্ষা করছেন।
প্রতিবছর গরু কোরবানি দেন উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা হারুন সরদার। তিনি বলেন, যে গরুর দাম ৮০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে তা মূলত ৫০ হাজার টাকা দামের গরু। আগে ১ লাখ টাকার গরু দেখলেই বোঝা যেত এর দাম লাখের ওপরে। এখন মাঝারি আকারের গরুর দাম জিজ্ঞাসা করলেও বলে দেড় লাখ। যদি বাজারের দশা এমন থাকে তাহলে সবাই শেষ রাতের জন্য অপেক্ষা করবে।
তবে কোরবানির শেষরাত বিগত বছর অনেক ব্যবসায়ীদের কাছে ছিল বিভীষিকার মতো। ক্রেতারা শেষ রাতের জন্য অপেক্ষা করেছে, ওদিকে বিক্রেতারাও শেষ রাতে বিক্রি বাড়বে বলে দাম কমাননি। এতে করে কোরবানির রাত ফুরিয়ে গেলেও দাম বেশি চাওয়ার কারণে অনেক ক্রেতা কোরবানি দেননি। এতে করে কোরবানির পরদিন ব্যাপারীদের অবিক্রীত গরু নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল।
২০২৩ সালে অবিক্রীত ২৬টি গরু নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন গাইবান্ধার আউয়াল মুন্সী। এবারও ভাটারা হাটে গরু নিয়ে এসেছেন তিনি। সময় সংবাদকে বিগত বছরের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আউয়াল বলেন, গতবছর কোরবানির আগের দিন শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টির পর গরুর দাম কমতে শুরু করে। অনেক ব্যাপারী লোকসান করে হলেও নিজেদের গরু বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। রাত বাড়তে থাকলেও সেবার ক্রেতা বাড়েনি। এতে করে প্রতিটি হাট থেকে লাখ লাখ অবিক্রীত গরু নিয়ে ফিরতে হয়েছে ব্যাপারীদের। এক গাবতলী হাটেই ১৫ লাখের মতো গরু ছিল অবিক্রীত।
আউয়াল বলেন, বিক্রি না হওয়া এসব গরু পরবর্তীতে ব্যাপারীরা বাধ্য হয়ে এলাকার কসাইদের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে করে কাঙ্ক্ষিত লাভের মুখ দেখেননি তারা। এবার গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য কোরবানির আগের দিনের জন্য অপেক্ষা না করে, শনিবারের (১৫ জুন) মধ্যে সব গরু বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আউয়ালের মতো বিক্রেতারা।
মূল্যস্ফীতির বাইরে ক্রেতাদের আগ্রহ কমে আসার আর কোনো কারণ থাকতে পারে কিনা জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী শামসুল হুদা সময় সংবাদকে বলেন, শুধু কোরবানির ঈদ না, রোজার ঈদ নিয়েও রাজধানীর মানুষের মধ্যে এক ধরনের নির্লিপ্ততা কাজ করে। মানুষের জীবন যতটা যান্ত্রিক এবং মেট্রোপলিটন কেন্দ্রিক হয়ে যাবে মানুষ এসব আনন্দ-উত্তেজনার প্রতি ততটাই নির্লিপ্ত হয়ে যাবে।
এক দশক আগেও কোরবানির এক সপ্তাহ আগে থেকেই হাট জমে উঠতো। হাট থেকে গরু কিনে এনে চার পাঁচদিন নিজেরা সেই গরু পালতো। এতে করে যে পশুটি কোরবানি দেয়া হবে সেটা নিয়ে বুড়ো থেকে বাচ্চা সবার মধ্যে উৎসবের এক আমেজ কাজ করতো। এখন মানুষ খামার থেকে গরু কিনে খামারেই রেখে আসে। অনেকে অনলাইনে গরু কেনে যে গরু ডেলিভারি দেয়া হয় কোরবানির দিন সকাল বেলা। এতে করে যে পশুটিকে কেন্দ্র করে আত্মত্যাগ সেটির সঙ্গেই কোনো আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় না। এসব কারণে দিন যত যাচ্ছে কোরবানি বা হাট নিয়ে মানুষের উত্তেজনা তত কমে আসছে বলে জানান এ সমাজবিজ্ঞানী।