ইসরায়েল নীতি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় বাইডেন
ফিলিস্তিনের হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করে বেশ বিপাকে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অনেকেই ওই পোস্টের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে চাপ বাড়ছে, তাতে নতি স্বীকার করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
গত মঙ্গলবার এক্সে (সাবেক টুইটার) ওই পোস্টে বাইডেন লিখেছিলেন, ‘ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেয়ে বেশি আর কিছুকে ভয় পায় না হামাস। তাই তারা ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যা ও যুদ্ধের পথে এগোলে হামাস যা চায়, সেই সুযোগ করে দেওয়া হবে। আমরা সেটি করতে পারি না।’
ওই পোস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, হামাসের হামলা ও গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণকে নৈতিক জায়গা থেকে এক হিসেবে তুলে ধরেছেন বাইডেন। এ নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন টুইট করেছেন, ‘হলোকাস্টের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিধন) পরবর্তী সময়ে ইহুদিদের ওপর চালানো সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর ইসরায়েলের ওপর চড়াও হতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় নিলেন বাইডেন। ইসরায়েলের পদক্ষেপকে সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করলেন তিনি।’
অনেকেই আবার বাইডেনের ওই টুইটের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, এর মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন—ইসরায়েলের আগ্রাসী সামরিক অভিযান কীভাবে হামাসকে সহায়তা করছে। এ ছাড়া সংঘাতের এক পর্যায়ে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিরোধিতাও করেছিলেন বাইডেন। এ নিয়ে তাঁকে প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এখন টুইটের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওই সমালোচনার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন—এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাইডেন হয়তো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত ঘিরে নিজের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ভয়ও পেয়েছেন। গত বুধবার এক্সিওস নামের সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটে অলাভজনক সংস্থা আরব-আমেরিকান ইনস্টিটিউটের একটি পরামর্শ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের আরব বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তায় নাটকীয় ধস নেমেছে।
এ বিষয়ে ইহুদি ধর্মযাজক রায়ে আবিলেয়াহ বলেন, ‘সম্ভবত জনগণের আন্দোলন ও গণতন্ত্র কাজ করার কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচিত নেতাদের কাজ হলো তাঁদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা, যাঁরা গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন এবং যাঁরা এই জঘন্য সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এই সহিংসতা আমরা মুঠোফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছি, যেমনটি আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সহিংসতা দেখেছিলাম।’
বাইডেন হয়তো ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত ঘিরে নিজের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ভয়ও পেয়েছেন। গত বুধবার এক্সিওস নামের সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটে অলাভজনক সংস্থা আরব–আমেরিকান ইনস্টিটিউটের একটি পরামর্শ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের আরব বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তায় নাটকীয় ধস নেমেছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর গাজায় অব্যাহত বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ ছাড়া ইসায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে ধরে গাজায় এনে জিম্মি করেন হামাস সদস্যরা। অন্যদিকে ইসরায়েলের বোমার আঘাতে নিহত হন প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এর মধ্যে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় তিন দফায় যুদ্ধবিরতি পালিত হয়েছে। চুক্তির শর্ত হিসেবে হামাস ও ইসরায়েল—দুপক্ষই জিম্মি ও বন্দী বিনিময় করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে বাইডেনকে এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে হয়েছে, যিনি নিজের নৈতিকতা, ইসরায়েলের প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থন এবং নির্বাচনের আগ দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করার মতো বিষয়গুলো সামাল দিতে গিয়ে চাপে আছেন। সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের মেয়াদকালের অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে গাজা সংঘাত কীভাবে মার্কিন প্রশাসনকে বেশি নাড়া দিয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে বাইডেনের একটি মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ফিলিস্তিনিদের হতাহতের তথ্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, গাজায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ফিলিস্তিনিরা সত্যি বলছেন কি না, সে বিষয়ে তাঁর ধারণা নেই। পরদিনই ওই মন্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ মুসলিম নেতার অভিযোগের মুখে বাইডেন বলেছিলেন, ‘আমি দুঃখিত। আমি নিজেই হতাশ। ভবিষ্যতে ভালো করার চেষ্টা করব।’
বাইডেনের নীতি নিয়ে হোয়াইট হাউসে বিভক্তির খবর সম্প্রতি প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, বাইডেনের নীতি নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সমর্থকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের কথা। এমনকি হোয়াইট হাউসের অনেক তরুণ, বিশেষ করে আরব ও মুসলিম বংশোদ্ভূত কর্মীরা জানিয়েছেন, যে প্রেসিডেন্টের জন্য কাজ করছেন, তাঁর প্রতি তাঁরা সন্তুষ্ট নন।
এরপরই বাইডেনের নীতি নিয়ে হোয়াইট হাউসে বিভক্তির খবর প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, বাইডেনের নীতি নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সমর্থকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের কথা। এমনকি হোয়াইট হাউসের অনেক তরুণ, বিশেষ করে আরব ও মুসলিম বংশোদ্ভূত কর্মীরা জানিয়েছেন, যে প্রেসিডেন্টের জন্য কাজ করছেন, তাঁর প্রতি তাঁরা সন্তুষ্ট নন।
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে গাজা সংঘাত নিয়ে বাইডেনের সুর বদলেছে। প্রথম দিকে তিনি যা বলেছিলেন, সেভাবে ইসরায়েলের পক্ষে আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেননি। পরে এসে সেই বাইডেনই গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি ও যুদ্ধবিরতির পক্ষে কথা বলছেন। হোয়াইট হাউস এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছে যে তারা দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে না।
তবে মঙ্গলবার বাইডেনের ওই টুইটে ইসরায়েলের প্রতি তাঁর সমর্থন হালকা হয়নি বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম জিউস ইনসাইডারকে বলেন, ‘তিনি (বাইডেন) বোঝাতে চেয়েছেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা ত্যাগ করতে পারি না।’
হোয়াইট হাউসের এই বক্তব্য আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল জাস্টিস ডেমোক্র্যাটসের নেতা উসামাহ আন্দ্রাবি। তিনি বলেন, ডেমোক্রেটিক মতাদর্শের লোকজন বাইডেন প্রশাসনের কাছে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তির পক্ষের পদক্ষেপ চায়। তবে হোয়াইট হাউস তা সামান্যও করে দেখাতে পারেনি। ডানপন্থীদের চাপের কারণে নিজের ভোটারদের বড় অংশের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বাইডেন।
এদিকে মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট সদস্যরা গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাওয়ার শর্তে তাঁরা উপত্যকাটি ঘিরে ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনের কথাও বলছেন। দলে বাম ঘরানার অনেকে গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে পাশে থাকায় বাইডেনের নিন্দা করেছেন। এতে করে ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে বিভক্তি ঠেকানোর মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন বাইডেন।
এ নিয়ে ওয়াশিংটভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইথিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারের গবেষক হেনরি ওলসেন বলেন, যুদ্ধবিরতি ও হামাসকে নির্মূল করা—এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো অবস্থান নেই। তাই প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন শেখ নেয়ামত উল্লাহ।