আইএমএফের ঋণের দীর্ঘ মেয়াদি ফাঁদে বাংলাদেশ
আপাতদৃষ্টিতে আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন কিছুটা ঠেকানো গেলেও এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুফল বয়ে আনবে না। কেননা এ ঋণের বাকি কিস্তির অর্থ পেতে সরকারকে অনেক কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে।
আবার এ ঋণ বিদেশি অন্য ঋণের কিস্তি পরিশোধের ওপর চাপ আরও বাড়াবে। বরং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া গেলে এবং বিদেশের শ্রমবাজারে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরও বাড়ানো যেত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আইএমএফের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু এ ঋণই নয়, অতীতে আইএমএফ বাংলাদেশকে যত রকমের ঋণ সহায়তা দিয়েছে সব সময়ই এরকম কঠিন কঠিন সংস্কারমূলক শর্ত পরিপালন করিয়েছে। এসব শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে কৃষি ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে এসব ঋণ প্রকল্প দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো এবং সরকার গঠিত অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্র্য বলেন, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছে। এখান থেকে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। আইএমএফের ঋণ পেতে বিগত সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক সূচকের মান ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- আর্থিক খাতের সংস্কার, মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি। একই সঙ্গে মানব উন্নয়ন সূচকেও রয়েছে লুকোচুরির খেলা। ফলে বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেক এগিয়েছে দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এসব সূচকের সত্যতা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে বাজেটের স্পর্শকাতর তথ্যও জানাতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা মানতে গিয়ে কমিয়ে আনতে হচ্ছে কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের ভর্তুকি। মূল্যস্ফীতির চাপ অসহনীয় হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খাতের ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার চাপ দিচ্ছে আইএমএফ। যদিও ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ খাতের সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচক চাপ রয়েছে আইএমএফের। শুধু তাই নয়, পাবলিক এক্সপেন্ডেচার (সরকারি খাতের ব্যয়) বিশেষত পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার চাপও রয়েছে। এজন্য আগের সরকারের মতোই কৃচ্ছ্রসাধনের রাস্তায় হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকারও। অন্যথায় ঋণের কিস্তি আটকে দেওয়া হবে এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছে আইএমএফ। ইতোমধ্যে চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের সময়সীমা কিছুটা পেছানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইএমএফের শর্ত পরিপালন হলে কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং আদানির সঙ্গে অনৈতিক চুক্তি বাতিল করতে হবে। এ সময় ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে। এজন্য রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে এসে সৌরবিদ্যুতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, রেন্টাল, কুইক রেন্টালে মহাদুর্নীতি হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এসব দুর্নীতি নিয়ে আইএমএফ কিছু বলছে না। আরও ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানোর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
আইএমএফের দেওয়া শর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করছে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি। বাংলাদেশকে এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। সংস্থাটির দেওয়া শর্তের প্রায় সব পূরণের পথে থাকলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তবে বেশির ভাগ শর্ত পূরণের অগ্রগতি দেখিয়ে এরই মধ্যে কিস্তি ছাড় করা হয়েছে। সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি ৩ ডিসেম্বর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে শর্তগুলো পরিপালনের বিষয়ে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই সফরে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে আছে নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য, রিজার্ভ মানি, কর রাজস্ব, অগ্রাধিকার সামাজিক ব্যয় এবং সরকারের মূলধন বিনিয়োগ। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার সব শর্ত পূরণে অগ্রগতি দেখাতে পারলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিয়মিত ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নে যেতে হবে। অন্যথায় কিস্তি আটকে দেবে। এ মুহূর্তে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব শর্ত মানতে গিয়ে সরকারকে অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের কাঁধে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইএমএফের ঋণ পেতে যে কোনো দেশকেই সাধারণত কঠিন শর্ত মানতে হয়। বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণ প্রকল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এতে সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং কৃষি খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি ট্যাক্স বাড়াতে হচ্ছে। এ পদক্ষেপগুলো আর্থিক খাতের ভারসাম্য আনার জন্য করা হলেও বাস্তবতা বিবেচনায় দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বাজেট বাস্তবায়ন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা সরকারের নীতি প্রণয়নের মতো জায়গায় ঢুকে পড়েছে আইএমএফ। ঋণ পেতে হলে তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে হবে। তাদের মতো পলিসি নিতে হবে। যার ফলস্বরূপ বিদ্যুৎ খাতে মহাদুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন ড. মইনুল ইসলাম। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও ভর্তুকি কমাতে হচ্ছে। যার কারণে নিম্ন শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সাড়ে ১৮ কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে সামাজিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এমনিতেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত চাপ নিয়ে চলছে। ২০২৪ সালের পর এই চাপ আরও বাড়বে। এরপর এর সঙ্গে যুক্ত হবে আইএমএফের চলমান ঋণ প্রকল্পগুলোর কিস্তি পরিশোধও, যা সামষ্টিক অর্থনীতিকে আরও বিপর্যস্ত করবে। তবে আইএমএফের দেখানো আর্থিক খাতের সংস্কারমূলক কার্যক্রমগুলো দেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সেগুলো ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে না পারলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে ব্যর্থ হবে, এতে দেশ ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে, যা আরও ঋণ গ্রহণে বাধ্য করবে এবং পরনির্ভরশীলতার এক চক্র তৈরি করবে। পৃথিবীর অনেক দেশ এমন চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যা মধ্যম আয়ের ফাঁদ নামেও পরিচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন