পতিত সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এর মধ্যেও জুলাইয়ের নেতিবাচক অবস্থা থেকে অক্টোবর নাগাদ রাজস্ব আদায়ে পৌনে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগের অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাওয়ায় শুরু থেকেই এবারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ফলে স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী তিন মাসে পৌনে ৯ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির পরও লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৩ শতাংশের বেশি ঘাটতি থেকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাসম্ভব অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন মেয়াদের সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে অটোমেশন করা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ রয়েছে এই সংস্কার উদ্যোগে। কর্মকর্তারা আশা করছেন অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: আব্দুর রহমান খান রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করে দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, আমরা সরকারের অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে রাজস্ব আদায়ে গতি আনার চেষ্টা করছি। আমরা জানি বর্তমান বাস্তবতায় রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং। আমরা রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও অটোমেশন এনে এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে চাই।
তিনি উল্লেখ করেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার দিক নির্দেশনা অনুসারে আমরা রাজস্ব আদায়ে গতি আনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। তারা একটি স্বচ্ছ রাজস্ব প্রশাসন তৈরির বিষয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন। এই পরামর্শকে সামনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের বিভিন্ন মেয়াদে উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ করছে।
এনবিআর সূত্র থেকে জানা গেছে, পতিত সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে এনবিআরভুক্ত খাত সমুহে রাজস্ব আদায়ে ৭.১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। পরবর্তী আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা গণবিস্ফোরণের মুখে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। নতুন সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। এর ফলে আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.৩৪ শতাংশ কমে ২১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ দেয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এতে সেপ্টেম্বর মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে বের হয়ে ২ শতাংশের কিছু বেশি ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এ মাসে এনবিআর রাজস্ব আদায় করে ২৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের রাজস্ব কমানোর পরও অক্টোবর মাস নাগাদ ৮.৬৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়। অক্টোবর মাসে এনবিআর এর রাজস্ব আদায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসে রাজস্ব আদায় হয় এক লাখ এক হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।
জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান গত ১২ আগস্ট যোগদানের পর নতুন সরকারের দিকনির্দেশনায় এনবিআরকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনি মাঠ পর্যায়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি ও বিধিবিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এনবিআরে দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন পদোন্নতির জট খোলেন তিনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে উভয় ক্যাডারে মাঠপর্যায়ে বৈষম্য নিরসনে কমিশনার থেকে সহকারী কমিশনার পদে ব্যাপক রদবদল করেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এখন বৈষম্য নিরসনে ভ্যাট, আয়কর এবং কাস্টমস খাতে আইন ও প্রায়োগিক সংস্কার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে। দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণের ভিত্তিতে দায়ী করদাতা ও জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বোর্ডের অধীনে তিনটি অনুবিভাগ মূল্য সংযোজন কর, আয়কর ও কাস্টমসের পাশাপাশি বোর্ড প্রশাসন, আইসিটি এবং গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগ পৃথকভাবে সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এর মধ্যে আয়কর বিনিয়োগ ও সেবাবান্ধব কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে আবশ্যক করণীয় ১৪ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর আইন সংস্কারে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার কার্যক্রমের সুবিধার্থে পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, কর ফাঁকি উদঘাটন ও প্রতিরোধের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে এনবিআর কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি), ঢাকা তদন্তকৃত ও ফাঁকি উদঘাটিত ১৬৭টি মামলার মধ্যে ১৫২টি আয়কর এবং ১৫টি ভ্যাট ও কাস্টমসের মামলা রয়েছে। সিআইসি ফাঁকিকৃত রাজস্বের ৭৪ কোটি টাকা আদায় করে। চলমান কর মামলাগুলোর মধ্যে মোট ৩৭টি মামলার ব্যাংক ফ্রিজ করা হয় এবং ৬টি মামলার ব্যাংক আন-ফ্রিজ করা হয়। ৮৭টি গুরুত্বপূর্ণ আয়কর মামলা তদন্তের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। বড় ধরনের কর খেলাপিদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা দায়ের করা হয়েছে। আয়কর আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে অনলাইন রিটার্ন দাখিল প্লাটফর্ম নতুন আঙ্গিকে চালু করা হয়েছে; তিন মাসে ২.৬৯ লাখ করদাতা অনলাইনে ইটিআইএন রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করেছেন; গত ২ মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার করদাতা অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন।
বাজারে মূল্যকে জনগণের জন্য সহনীয় রাখতে এর মধ্যে পেঁয়াজ, আলু, কীটনাশক, ডিম, চিনি, চাল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য শুল্ক কর হ্রাস ও প্রত্যাহার করা হয়েছে; পেঁয়াজে রেগুলেটরি ডিউটি ৫% সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আলু আমদানি শুল্ক ২৫% হতে হ্রাস করে ১৫% এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৩% সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। কীটনাশক আমদানি শুল্ক ২৫% হতে হ্রাস করে ৫% এবং সমুদয় রেগুলেটরি ডিউটি ও ভ্যাটপ্রত্যাহার; ডিম আমদানি শুল্ক ২৫% হতে ৫% এ হ্রাসকরণ; চিনির ওপর রেগুলেটরি ডিউটি ৩০% হতে হ্রাস করে ১৫%; পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টাকা প্রতি টন ৬ হাজার টাকা কমিয়ে ৪,৫০০ টাকা করা হয়। চাল আমদানি শুল্ক ২৫% হতে ১৫% এ নামানো হয়; রেগুলেটরি ডিউটি ২৫% হতে ৫% এ করা হয়।
স্বর্ণ চোরাচালান ও রোধ এবং ব্যাগেজ ব্যবস্থায় স্বর্ণ আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাগেজ রুল সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইএক্সপি ব্যতীত (নমুনা এবং অন্যান্য) পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিংয়ের ঝুঁকি নিরসনের উদ্দেশ্যে ১০০ কেজি বা তদূর্ধ্ব ওজনের পণ্যচালান বাধ্যতামূলক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আনা হয়েছে; ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যথাযথ কাস্টমস নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকল্পে বেপজা কর্তৃক ইস্যুকৃত ইম্পোর্ট পারমিট এবং এক্সপোর্ট পারমিট ব্যতীত পণ্য রফতানি বারিত করা হয়েছে।
সংস্কারের আওতায় কর সংগ্রহ ও বৃদ্ধিতে করজাল বিস্তৃতকরণ; কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং লক্ষ্যে অর্জনে সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ; করযোগ্য প্রতিটি লেনদেন মনিটরিং ব্যবস্থা সফল করার লক্ষ্যে ক্যাশলেস সমাজ তৈরিতে আনুক্রমিক পদক্ষেপ গ্রহণ; নিকটভবিষ্যতে এআই ব্যবহার করে সর্বপ্রকার করফাঁকি উদঘাটন, চিহ্নিতকরণ ও আদায় মনিটরিং এর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আয়কর খাতে রাজস্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রিটার্ন সম্পূর্ণ অনলাইনে গ্রহণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে; করদাতা সেবা সহজীকরণ মোবাইল ইউজারদের জন্য ই-রিটার্ন অ্যাপস তৈরি করা হবে; আয়কর ও ভ্যাটের অডিট সিলেকশন প্রক্রিয়া অটোমেটেড করা হবে; পেপার রিটার্নে পেশকৃত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের জন্য ডাটা এন্ট্রির কার্যক্রম স্বল্পতম সময়ে সমন্বয় করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিগত সরকারের আমলে প্রতি বছরই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতি থেকে যেত। মূল রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রাকে সংশোধিত বাজেটে কমানোর পরও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ঘাটতি থেকে যেত। এর ফলে নতুন অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার সাথে সে ঘাটতি যুক্ত হয়ে রাজস্ব আদায়ে এক অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা তৈরি হয়। এবারো একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন