শাহদীন মালিক
কমবেশি দেড় বছর ধরে পত্রিকাগুলো সংবাদে, সম্পাদকীয়তে বা কলামে ঘুরেফিরে দুটি বিষয়ে তথ্য পরিবেশন করছে অথবা মন্তব্য বা মতামতের পসরা মেলে ধরেছে। বিষয় দুটি পাঠক অতি সহজেই আঁচ করতে পারবেন। প্রথমটি হলো আলু, ডিম আর পেঁয়াজ। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হম্বিতম্বি মাঝেমধ্যে জেল-জরিমানা, কখনোবা বাণিজ্যমন্ত্রীর আশ্বাস এবং ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে মিষ্টি মিষ্টি আহ্বান।
পক্ষান্তরে আলু, ডিম, পেঁয়াজ যাঁরা খান, সেই ভোক্তা নামীয় প্রাণীদের হতাশা আর আর্তনাদ। অবশ্য ব্যাপারটা যাতে একেবারে একঘেয়ে না হয়ে যায়, তাই এই তালিকায় মাঝেমধ্যেই দেখা মেলে আড়াই শ বা তিন শ টাকার কাঁচা মরিচের; ব্রয়লারও হয়ে পড়ে আড়াই শ টাকা কেজি; টিভি সংবাদে চার-চারটা ইলিশ হাতে খুব উৎফুল্ল সুরে ক্রেতার ১০ সেকেন্ডের ক্লিপ শুনেছি, ‘এই চারটা ইলিশ কিনেছি সাড়ে নয় হাজার টাকায়।’
কদাচিৎ যে সপ্তাহে দাম বাড়ে না, সেই সপ্তাহে ডিম, আলু, পেঁয়াজ খবর থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু দেড় বছর ধরে দ্বিতীয় যে বিষয়টি খবরের কাগজ থেকে কখনো হারিয়ে যায়নি, সেটি হলো আগামী নির্বাচন। প্রথম বিষয়টি, অর্থাৎ আলু, ডিম, পেঁয়াজের সঙ্গে জড়িত প্লেয়াররা হলেন হতাশ ও হতবিহ্বল করুণ চেহারার ক্রেতারা; আর অন্যদিকে পাইকারি বিক্রেতারা, মাঝেমধ্যে কদাচিৎ বড় আড়তদারেরা আর আলোচনার মধ্যমণিতে থাকা কিন্তু কখনো তাঁদের নাগাল না পাওয়া ‘সিন্ডিকেট’।
মন্ত্রী যিনি আছেন, তাঁর সম্ভবত দৃঢ়বিশ্বাস যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ধরপাকড় করে এই ডিম, আলু, পেঁয়াজকে তাঁর কথা শোনাতে পারবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আটক করলে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জেলহাজতে পাঠালে তাঁরা নিশ্চয়ই অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও দমে যান। কিন্তু ডিম, আলু, পেঁয়াজ তো বাণিজ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া আইন বোঝে না।
প্রথম বিষয়ে প্লেয়ারদের থেকে দ্বিতীয় বিষয়ের প্লেয়াররা সংখ্যায় অনেক সীমিত এবং বহুল পরিচিত। আগামী নির্বাচনসংক্রান্ত অন্যতম একজন বড় প্লেয়ার, অর্থাৎ মির্জা ফখরুলের গতকাল সন্ধ্যায় এই লেখার সময় পর্যন্ত ঠিকানা ছিল মিন্টো রোডের ডিবি অফিস। সংবাদমাধ্যম বলছে, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর জন্যও একই ঠিকানার আমন্ত্রণপত্র নিয়ে পুলিশ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে।
এসব ক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সবার পরিচিত। মির্জা ফখরুলসহ ধৃত বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার পর বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর করলে আবার ডিবি অফিসে আনা হবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই আইনকানুনে আজকাল খুব বেশি কিছু আসে যায় না। বছর বিশেক আগে হাইকোর্ট একটা বিস্তারিত রায়ে গ্রেপ্তার-পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদ এবং আনুষঙ্গিক অনেক ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করণীয় স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
সেই রায়ের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী মির্জা ফখরুলসহ যেকোনো ব্যক্তির গ্রেপ্তার মহানগরে হলে গ্রেপ্তারের চার ঘণ্টার মধ্যে আর মফস্সলে হলে যেখানে যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত, সেখানে আরও কয়েক ঘণ্টা বেশি ব্যয় করে হলেও গ্রেপ্তার ব্যক্তির একজন নিকটাত্মীয়, বন্ধু অথবা আইনজীবীর উপস্থিতিতে তাঁর সওয়াল-জবাব হওয়ার কথা।
হাইকোর্টের রায়টি অনেক বছর পর আপিল বিভাগও মঞ্জুর করেছিলেন। সংবিধানেও বলা আছে, কারও প্রতি অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অসম্মানজনক আচরণ এবং ব্যবহার করা যাবে না। তবে ক্ষমতার ভারে যাঁরা পিষ্ট, তাঁদের কর্ণকুহরে এসব কথা প্রবেশ করে না।
এই দ্বিতীয় বিষয়ের অন্য অংশের মাঠে-ময়দানের নেতৃত্বে যে অন্তত যে দুজন মন্ত্রীকে প্রায় প্রতিদিন দেখা ও শোনা যায়, তাঁরা অনেকটা পাঠানদের সাচ্চা কথার মতো একই বাক্য তাঁরা পুনরাবৃত্তি করেই যাচ্ছেন, দেড় বছর ধরে। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী।
২.
২৮ ও ২৯ অক্টোবর তারিখের ঘটনাপ্রবাহে যে বিষয়টা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেটি হলো প্রথমত নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের অধীনেই হবে; দ্বিতীয়ত, ২৯ তারিখের হরতালের প্রতি দেশের বড়-ছোট প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে এটাও স্পষ্ট যে তারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। অবশ্য জাতীয় পার্টি এই ডামাডোলের মধ্যেও মোটামুটি চুপচাপ। ধারণা করছি, আগামী জানুয়ারির নির্বাচনে রওশন এরশাদের বলয়ের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও জি এম কাদের এবং তাঁর অনুসারীরা নির্বাচনী খেলার মাঠে না–ও নামতে পারেন।
সরকার বেধড়ক ধরপাকড় করে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সব রাস্তাই বন্ধ করে দিচ্ছে এবং দেবে। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে ৩০ বা ৩১ অক্টোবর মির্জা ফখরুলকে রিমান্ডে পাঠানোর মধ্য দিয়ে। যদি তাঁকে ৫ থেকে ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে দেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচনের স্পষ্ট হতে যাওয়া চেহারাটার ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়তা আরও বাড়বে।
এই ২৮ তারিখের আগে, প্রায় দেড় বছর ধরে একই দিনে এবং একই শহরে আরও বহুবার সম্মেলন, মহাসম্মেলন এবং প্রতি-উত্তরে শান্তিমিছিল ও শান্তি সমাবেশ হয়েছে। এবার ব্যতিক্রমটা কেন হলো, কীভাবে হলো এর জন্য মূলত দায়ী কে, তার কোনো সঠিক উত্তর শিগগির মিলবে না। সরকারপক্ষের কারণ বিশ্লেষণে জানা গেছে, ২৯ অক্টোবরের মধ্যাহ্নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে। সব দোষ নন্দ ঘোষের। ২৯ তারিখের হরতালের কারণ বিশ্লেষণও একই রকম—ওদের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল।
৩.
কোনো ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষ, গোত্র, গোষ্ঠী, ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরা, ভিন্নমতাবলম্বী ইত্যাদি সব মহাদেশেই দশকের পর দশক কিল-ঘুষি, ছুরি-বর্শা, তলোয়ার, বিরাট বিরাট হাতুড়ি নিয়ে খুনখারাবি করেনি, এমন এলাকার নাম অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ধর্মযুদ্ধ শুরু হলে তা বন্ধ করার শান্তি আলোচনার সূত্রপাত ঘটত অন্তত ৫০ বছর পর।
ইতিহাস কচলাব না, তাই এক বাক্যেই শেষ করছি এই কথা বলে যে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় বড়দাগে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিগ্রহ হয়নি বললেই চলে। আপনি আক্রমণ করলেন আর দুই দিনের মাথায় আমি সারেন্ডার করলাম, এটা তো যুদ্ধ হলো না। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধসহ দু-একটা ব্যতিক্রম আমাদের অঞ্চলেও আছে।
খুব পেছনে ফিরে না গিয়েও ১৯৮০-এর দশকে ইরাক-ইরানের যে যুদ্ধ, সেটাকে একটা ছোটখাটো ধর্মযুদ্ধ বলা যায়। কারণ, যুদ্ধের এক পক্ষ ছিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের অধীনের সুন্নিরা আর অন্য পক্ষে ছিল ইরানি শিয়ারা। আর যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাই উভয় পক্ষকে তাল দিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অর্থাৎ আগামী নির্বাচন হবে একতরফা। তবে যারা সংবিধানের মূল চেতনা বোঝে না, কিন্তু সংবিধানে ব্যবহৃত শব্দগুলো পড়তে পারে, তাদের বিবেচনায় নির্বাচন হবে সংবিধানের আওতায়। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার তখনই বেকায়দায় পড়ে, যখন ওই সরকারগুলো অর্থনীতিকে সামাল দিতে পারে না।
সাংবিধানিক নির্বাচনের পর অর্থনীতি বেসামাল হলে এই নির্বাচনটা সরকারের জন্য খুব বেশি কাজে দেবে না। তবে অর্থনীতি যদি সরকারের মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে ধর্মযুদ্ধ না হলেও একটি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বজায় থাকবে বহু বছর।
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন