Image description

জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ১২৪টি ‌'রাজনৈতিক সহিংসতার' ঘটনায় ১৫ জন নিহত এবং ৯৮৭ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলেই আহত হয়েছেন ৬৭৭ জন এবং নিহত হয়েছেন ৫ জন। এছাড়া, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল, বিএনপি-আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অন্তর্কোন্দল এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘটিত সংঘর্ষে ৩১০ জন আহত হয়েছেন। 

আজ সোমবার প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও এ দেশের মানুষ এখনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পায়নি। স্বাধীনতার পর গত ২০২৪ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভীতিকর ও চরম উদ্বেগজনক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসলে জনতার মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হলেও তার প্রতিফলন মূলত ঘটেনি। সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফলতা দেখাতে পারেনি। ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা থাকলেও এর প্রকৃত অবস্থা হতাশাজনক। নতুন বছরের নতুন মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে নতুনত্ব আসার কথা থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্বের ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি এতে নতুন ধারাও যুক্ত হয়েছে। 

এতে আরও বলা হয়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, মাসজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, হেফাজতে ও নির্যাতনে মৃত্যু, গণপিটুনিতে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ, উত্তেজনা, বিএসএফের বিধি লঙ্ঘন করে বেড়া নির্মাণ, উস্কানি, এমনকি নিরীহ বাংলাদেশিকে পিটিয়ে হত্যা এবং মিয়ানমারের আরাকান আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশি জাহাজ আটক এবং সীমান্তে গুলি, মাইন ও মর্টারশেল বিস্ফোরণের মত বিভিন্ন বিষয় মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাস্তা বন্ধ করে প্রতিনিয়ত জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসির দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ঢাকার সাত কলেজ আন্দোলনে নামলে ঢাবির শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও জেল-হাজত, থানা ও পুলিশের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার অন্তত ৪ টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টের অভিযোগ রয়েছে । 

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদন বলছে, জানুয়ারি মাসে কমপক্ষে ১২৪ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯৮৭ জন। সহিংসতার ১২৪ টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৬৮টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬৭৭ জন ও নিহত ৫ জন, ২২টি  বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১০৬ জন ও নিহত ৪ জন, ৩টি  বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৬০ জন ও নিহত ১ জন,  ৩টি আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৫০ জন ও নিহত ৪ জন, ৫টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অন্তর্কোন্দলে, ৬ টি ছাত্রলীগ ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে এবং ১৭টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৫ জনের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে বিএনপির ৫ জন ও আওয়ামী লীগের ৪ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ৬ জন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। ১৫ জন নিহতের মধ্যে ৮ জন বিএনপির, ৬ জন আওয়ামী লীগের এবং ১ জন জামায়াতের কর্মী সমর্থক। এছাড়াও সারাদেশে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের হামলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আরও অন্তত ৭ জন রাজনৈতিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাম্পাসে কমপক্ষে ৯ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৪৩ জন।

রাজনৈতিক মামলা ও সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারিতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে কমপক্ষে ২৫টি মামলা হয়েছে। এ সকল মামলায় ১৭২৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৪৯০৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ মাসে কমপক্ষে ৩০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অন্তত ২২৮ জন। এ মাসে অন্তত ১৯ টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২৮ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সকল ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৯ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ২ জন ও গ্রেফতার হয়েছেন ১ জন। এছাড়াও ২ টি মামলায় ৬ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, ভিকটিমের পরিবার ও এইচআরএসএস এর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও নির্যাতনে ৪ জন এবং বন্দুক যুদ্ধে ১ জন নিহত হয়েছেন। ০২ জানুয়ারি  সকালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের কাট্টলি বিল এলাকার কিচিংছড়ায় এ অজ্ঞাত ইউপিডিএফ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ০৬ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে পুলিশের পিটুনিতে ইয়াসিন মিয়া নামে একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক এর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটকের পর নির্যাতন ও চিকিৎসা না দেয়ায় সোনাপুর ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান (৩৪)  হাসপাতালে মারা গিয়েছেন। গত ২৫ জানুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায় পদ্মা সেতুর পাশে এসআই নওশের আলির পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) মাদকবিরোধী অভিযানের সময় মিলন ব্যাপারী (৫৫) নামের এক মুদির দোকান্দার কে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও, ৩১ জানুয়ারি  গভীর রাতে বাড়ি থেকে যৌথবাহিনীর হাতে আটকের পর অমানবিক নির্যাতনের কারণে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক মো. তৌহিদুল ইসলাম (৪০) এর মৃত্যু ঘটেছে। অপরদিকে এ মাসে সারাদেশে কারাগারে কমপক্ষে ৭ জন আসামি মারা গিয়েছেন । ৭ জনের মধ্যে ৩ জন কয়েদি ও ৪ জন হাজতি । এ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক ৫ টি হামলার ঘটনায় ২ জন বাংলাদেশি নিহত, আহত ২ জন ও ১ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া, মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে ৩ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। 

গণপিটুনি, প্রতিমা ভাঙচুর এবং শ্রমিক নির্যাতন প্রসঙ্গে এইচআরএসএস জানায়, জানুয়ারিতে গণপিটুনির ১৩ টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ জন। এছাড়া, এ মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২ টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’র ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় ১৮ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া, এ মাসে ৩৯ টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮৭ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ৫ জন শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন। 

নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের পরিসংখ্যান জানিয়ে এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জানুয়ারি মাসজুড়ে কমপক্ষে ১২৭ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৪ জন, যাদের মধ্যে ২৮ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ১৪ জন নারী ও কন্যা শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী।  ১৬ জন নারী ও কন্যা শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তন্মধ্যে শিশু ৯ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ জন ও আহত হয়েছেন ২ জন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ২৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন নারী। অ্যাসিড সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১ জন নারী। অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে, ৮৮ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যাদের মধ্যে ৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৫২ জন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। 

সার্বিক পরিস্থিতিতে সুপারিশ জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ সকল বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। তাই “এইচআরএসএস”র পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় ও সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে এবং দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি- বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।