Image description

অপহরণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। দুষ্কৃতকারীরা অপহরণ করে স্বজনদের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করছে। এমনকি অপহরণের পর টাকা পেলেও খুন করতে দ্বিধা করছে না অপহরণকারী চক্র। এমন ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকা নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে, গত বছর সারা দেশে ৬৪২টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এবং বছরের শেষ চারমাসে অপহরণের ঘটনা ছিল ৩০২টি। এর আগের বছর সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ছিল ৪৬৩টি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটিত সকল অপরাধের পিছনে রাজনৈতিক বিরোধ, পূর্ব- শত্রুতা, সামাজিক-আর্থিক টানাপড়েনের সঙ্গে রয়েছে হতাশা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থ। এ সব ঘটনায় জনমনে তৈরি হচ্ছে ভীতি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ। অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা জরুরি।

চলতি বছরের ১১ই জানুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুরে আমিনুর রহমান (৪০) নামের এক চিকিৎসক অপহরণের শিকার হন। ৯ ঘণ্টা পর তিনি মুক্তি পান। আমিনুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, অপহরণকারীরা কয়েক দফায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া তাকে মারধর করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা, দু’টি স্মার্টফোন ও একটি ল্যাপটপ নিয়েছে অপহরণকারীরা। শ্রীপুরের মাওয়া চৌরাস্তায় একটি ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন আমিনুর। ঘটনার দিন দুপুরে ঢাকা থেকে তিনি শ্রীপুরে যান। ফেরার পথে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার দিকে তাকে মাওয়া চৌরাস্তায় মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অপহরণ করা হয়। তার মুঠোফোন নম্বর থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। কথা বলা অবস্থায় তাকে মারধর করা হচ্ছিল। রাতে তিন দফায় অপহরণকারীদের এক লাখ টাকা পাঠানো হয়। এভাবে মারধর করে দফায় দফায় টাকা দাবি করে। পরে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনাটি জানার পর তার মুঠোফোনের অবস্থান শনাক্ত করে। এবং তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান চালায়।

অভিনেত্রী রুবিনা আক্তার নিঝুমকে অপহরণের চেষ্টা করে উবার চালক রকি। পুলিশ জানায়, গত ২১শে জানুয়ারি দুপুরে অভিনেত্রী নিঝুম বনশ্রী নিজের বাসা থেকে ধানমণ্ডি-৩২ এ যাওয়ার জন্য উবার অ্যাপস এ কল করেন। কল করার পর উবার চালক রকি একটি গাড়ি নিয়ে তার বাসার সামনে আসলে তিনি গাড়িতে উঠেন। পরবর্তীতে রকি ধানমণ্ডি-৩২ না গিয়ে গুলশানের দিকে যেতে থাকে। এতে নিঝুম গুলশানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রকি ধমক দেয় এবং কোনো কথা না বলে চুপ থাকতে বলে। অপহরণের বিপদ বুঝতে পেয়ে এমন পরিস্থিতিতে নিঝুম চিৎকার করে আশপাশে থাকা মানুষের কাছে সাহায্য চান। এতে রকি গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দেয় এবং একই সঙ্গে নিঝুমকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। চলন্ত অবস্থায় নিঝুম গাড়ির একটি দরজা খুলে বের হয়। রকি দ্রুত গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিঝুম রামপুরা থানায় মামলা করেন। এ মামলায় রোববার রকিকে বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে এক শিক্ষককে অপহরণ করার পর ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে। ওই শিক্ষকের নাম মোহাম্মদ আরিফ (৪৯)। তার বাড়ি পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মাতবরপাড়া এলাকায়। তিনি পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনায় তার স্ত্রী থানায় জিডি করেছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২১শে সেপ্টেম্বর রাতে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে আরিফের মুঠোফোন থেকে পরিবারের কাছে কল দিয়ে বলা হয় তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তার মুক্তির জন্য পণ দাবি করা হয়। প্রথমে ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন অপহরণকারীরা। মুক্তিপণের টাকা নিয়ে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকায় যেতে বলেন অপহরণকারীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিপণ বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় ফোন করে ৩৫ লাখ, তৃতীয় দফায় ৪০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে পরিবার আরিফকে উদ্ধারে র‌্যাব ও পুলিশের সাহায্য চান।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বন্দুরা এলাকা থেকে প্রতীক নামে ১৩ বছরের এক স্কুল শিক্ষার্থীকে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করে। এ ঘটনায় ১৫ই জানুয়ারি ৫ অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্কুলে যাওয়ার পথে মাইক্রোবাস করে প্রতীককে অপহরণ করা হয়। পরে দুপুরে দোহার উপজেলার ফুলতলা এলাকা থেকে প্রতীককে উদ্ধার করা হয়। এ সময় গাড়িচালকসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- পারভেজ আহমেদ, জুম্মন খান ও মিজান। স্কুলছাত্র প্রতীক সরকার উপজেলার বান্দুরা হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্র্র্থী। সে নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা এলাকার সঞ্জয় কুমার সরকারের ছেলে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, গত চারমাসে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৩০২টি। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪২টি। এ বছর শুধু ঢাকা মহানগরেই ১৩২টি ঘটনা ঘটেছে। এবং গত বছরের শেষ চারমাসে ঢাকা মহানগরে ছিল ৮২টি। ২০২৩ সালে সাারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬৩টি এবং ঢাকা মহানগরে ছিল ৬১টি। এ বছরের শেষ চারমাসে ছিল ১৬০টি এবং ঢাকা মহানগরে ছিল ২১টি অপহরণের ঘটনা। ২০২২ সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬০টি। এছাড়া গত বছর চুরির ঘটনা ঘটে ৮৬৫৫টি, ডাকাতি ১৪১২টি এবং খুনের ঘটনা ঘটে ৩৪৩২টি। ২০২৩ সালে চুরির ঘটনা ৯৫৯১টি ডাকাতি ১২২৭টি এবং খুনের ঘটনা ৩০২৩টি। ২০২২ সালে চুরির ঘটনা ৯৫৯১টি, ডাকাতি ১১২৮টি এবং খুনের ঘটনা ৩১২৬টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, দেশের বাস্তবতায় কোনো একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখনকার অপরাধের পরিস্থিতি একরকম থাকে। অরাজনৈতিক কোনো সরকার থাকে তখনকার অপরাধ পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও একটা ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা, অপহরণ, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা- এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি। কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের পতনের পর নতুন যে অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হয়নি। দেশে একটি চক্রই তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এটি সংখ্যায় কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে। দেশে সকল অপরাধের মাত্রা যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো এসেছে আমরা প্রত্যেকটি ঘটনাই গভীরভাবে তদন্ত করছি। অপহরণের ঘটনায় ভুক্তভোগী উদ্ধারসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করতে হবে।