চার বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় পৃথক হত্যা মামলা হয়। চার বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনো বলতে পারছে না কাদের গুলিতে এ দুজন নিহত হয়েছেন।
মামলা দুটির একটির তদন্ত করছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ; অপরটির পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। স্বজনদের অভিযোগ, মামলা অগ্রগতি নেই বললেই চলে। নিহত দুজন হলেন মহল্লা সরদার আজগর আলী ও দিনমজুর মো. আলাউদ্দিন।
চট্টগ্রাম নগরের আমবাগান ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুলসংলগ্ন রেললাইন লাগোয়া বস্তিতে বড় বোনের সঙ্গে থাকতেন নিহত আলাউদ্দিন। মামলার বাদী ও নিহতের বোন জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানতেই পারলাম না আমার ভাইয়ের খুনি কারা।’
২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা চলছিল নগরের আগ্রাবাদ মগপুকুরপাড় এলাকায়। ওই সময় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী আজগর আলী। কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া নজরুল সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর আবদুল কাদের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।
নজরুলের পক্ষ নেওয়ার কারণে আবদুল কাদেরের সঙ্গে আজগরের বিরোধ দেখা দেয়। সেই বিরোধ থেকে আজগর খুন হন বলে দাবি করছেন পরিবারের সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত আজগর আলীর ছেলে সেজান মাহমুদ বাদী হয়ে আবদুল কাদেরসহ ১৩ জনকে আসামি করে ডবলমুরিং থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে পুলিশ আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় কাদেরসহ ২০ জন গ্রেপ্তার হন। সবাই স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী। বর্তমানে সবাই জামিনে আছেন।
শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ। চার বছরে বদল হয়েছেন সাত তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) মাহাবুবুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে কাজ চলছে। তবে কে করেছে, তা শনাক্ত করা যায়নি।
মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ছেলে সেজান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বিচার দূরে থাক, তদন্তই শেষ হয় কি না সন্দেহ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের মগপুকুরপাড় এলাকাটি কাদেরের এলাকা হিসেবে পরিচিত। ঘটনার দিন রাতে সেখানে নজরুল তাঁর সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণায় যান। এ সময় গুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল ও আশপাশে সাতটি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেগুলো ভাঙা পাওয়া যায়। কয়েকটির ফুটেজ পাওয়া গেলেও তা ছিল অস্পষ্ট। গ্রেপ্তার আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ কিছুই বের করতে পারেনি।
একই অবস্থা দিনমজুর আলাউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা মামলারও। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সময় গুলিতে মারা যান দিনমজুর আলাউদ্দিন। তিনি কারও অনুসারী ছিলেন না। ভোটকেন্দ্র-সংলগ্ন রেললাইনের সঙ্গে লাগোয়া বস্তিতে থাকতেন তিনি। সকালে নাশতা খেয়ে কাজে যাওয়ার পথে গুলিতে মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর বড় বোন জাহানারা বেগম বাদী হয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় মামলা করেন। মামলায় নয়জনকে আসামি করা হয়।
ঘটনার শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করে রেলওয়ে থানা-পুলিশ। তারা তদন্তে কোনো কিনারা করতে না পারায় সাত মাস পর সিআইডি তদন্ত শুরু করে। সূত্র জানায়, সিআইডি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সিসিটিভি ক্যামেরার ৫০০ জিবি হার্ডডিস্ক। সেটি থেকে ঘটনার দিনের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ফুটেজ মুছে ফেলা হয়।
আদালতের নির্দেশে সেই মুছে যাওয়া ফুটেজে কী আছে, তা পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে ফলাফল আসে শূন্য। ফুটেজটি নগরের খুলশী থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হিরণের বাসা থেকে সংগ্রহ করা হয়। ঘটনাস্থলের পাশে তাঁর বাসা। তিনি বিদায়ী কাউন্সিলর ছিলেন। দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় সেবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদুর রহমান তাঁর প্রার্থী বলে প্রচার রয়েছে।
এদিকে মামলার ৯ আসামির মধ্যে জামিনে রয়েছেন মো. আক্তার, বিল্লাল, সাজু, ইমন ও হেলাল। পলাতক রয়েছেন যুবলীগের কর্মী মো. নাছির, সাইদুল ইসলাম, জজ মিয়া, মো. নাসির। তাঁরা সবাই ওয়াসিমের অনুসারী।
মামলার অগ্রগতির বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক সুমন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, কে বা কারা গুলি করেছে, শনাক্ত করা যায়নি। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে ফুটেজটিতে কী আছে, তা পাওয়া যায়নি। এরপরও জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।