রাজধানীর জুরাইন কাঁচাবাজারে ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় পশু জবাই ও মাংস বিক্রির কর্মযজ্ঞ। দোকানের সামনে অপরিচ্ছন্ন-স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে গরু-খাসি জবাই করেন ব্যবসায়ীরা। সেখানেই মাংস কেটেকুটে দোকানে তোলেন। আর জবাইকৃত পশুর কারকাস (যা খাওয়ার উপযুক্ত নয়) ও রক্ত জমে গেলে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন স্থানটি।
রাজধানীর সর্বত্র প্রায় একই চিত্র। সূত্রাপুর বাজার, ধূপখোলা বাজার, পূর্ব রামপুরা বাজার, কাপ্তান বাজার, দয়াগঞ্জ বাজার, ডেমরা কাঁচাবাজার ছাড়াও নগরীর পাড়া-মহল্লায় মাংস বিক্রেতারা কেউ দোকানের সামনের রাস্তায়, কেউবা দোকানের মধ্যেই গরু-খাসি জবাই করছেন। উপরন্তু জবাই করা পশুটি রোগমুক্ত কি না তা দেখারও কেউ নেই। আবার মহিষ জবাই করে গরুর মাংস হিসেবে বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সে বিষয়টিও বরাবরই রয়ে গেছে তদারকির বাইরে।
জনবহুল এই নগরীর বিপুল ভোক্তার চাহিদা পূরণে এমন কর্মযজ্ঞে বিদ্যমান আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উদাসীন। কোনো নজরদারি নেই। ব্যবসায়ীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই করা পশুর মাংস গছিয়ে দিচ্ছেন ভোক্তাদের। পশুটি রোগাক্রান্ত হলেও তা ক্রেতার অজানা থেকে যায়। অনেকটা যেন গাঁটের টাকা দিয়ে রোগ কিনে বাড়ি ফেরা।
পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১ অনুযায়ী কোনো পশু জবাইয়ের আগে ও পরে একজন ভেটেরিনারি সার্জন দিয়ে সংশ্লিষ্ট পশুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাটা বাধ্যতামূলক। জবাইকৃত পশুর মাংস খাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সনদ দেবেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে বিধান মানার বালাই নেই। বাজারগুলোতে পশু জবাইয়ের সময় ভেটেরিনারি সার্জন খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সনদ ছাড়াই জবাই হচ্ছে পশু। আর অন্ধের মতো সেসব পশুর মাংস খেতে বাধ্য হচ্ছেন নগরবাসী। এতে করে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। একসময় রাজধানীর বাজারগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখা হতো বিক্রির জন্য রাখা মাংসের গায়ে ‘ফিটনেস’ সিল দেওয়া আছে কি নেই।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনকালে প্রতিদিনের বাংলাদেশের অনুসন্ধানে মাংস নিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির এমন ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে।
অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে পশু জবাই ও পশু পরীক্ষা না করার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মাংস বিক্রেতারা এজন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করেন। তারা বলছেন, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মিলে জবাইখানা রয়েছে মাত্র পাঁচটি। তার মধ্যে দুটি বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘদিন। বাকি তিনটিতে সিটি কর্তৃপক্ষের নজরদারি গা-ছাড়া।
বিক্রেতারা বলেন, পশু জবাইয়ের কাজটা সারতে হয় প্রতিদিন ভোরে। কিন্তু তখন সিটি করপোরেশনের কোনো ভেটেরিনারি সার্জন উপস্থিত থাকেন না। মাঝেমধ্যে বিকালের দিকে এসে তাদের একজন দেখা করে যান। অথচ ততক্ষণে জবাই করা পশুর মাংস বিক্রির পর্ব প্রায় শেষ হয়ে যায়।
একটি পশু জবাইয়ের ২৪ ঘণ্টা আগে সেটির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে হয় বলে জানান বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক শফিউল আহাদ সরদার স্বপন। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য ও নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ মানুষের মৌলিক অধিকার। জবাইয়ের ২৪ ঘণ্টা আগে সংশ্লিষ্ট পশুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে হয়, যাকে বলে এন্টিমর্টেম এক্সামিনেশন। পরীক্ষায় সুস্থ প্রমাণ হওয়ার পরই কেবল পশুটি জবাইয়ের অনুমতি দেওয়ার কথা। আবার জবাই শেষে চামড়া ছাড়ানোর পরও পশুর দেহের প্রতিটি অংশের মাংস পরীক্ষা করাতে হয়, যাকে বলে পোস্টমর্টেম এক্সামিনেশন।’
তিনি বলেন, পোস্টমর্টেম পরীক্ষার পরেই কেবল আমরা জানতে পারি যে মাংসের গুণগত মান ঠিক আছে কি না। অর্থাৎ পশুটির মাংস খাওয়ার উপযোগী কি না। কেননা অনেক সময় পশুর লিভার ও ফুসফুসে রোগের সংক্রমণ থাকতে পারে, যা কেবল জবাই করার পরই পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ছাড়া জবাই করা পশুর শরীরের যে অংশ রোগাক্রান্ত সে অংশের মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ। সেগুলো বাদ দিতে হয়।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে জবাইখানা রয়েছে মোট পাঁচটি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দুটির মধ্যে একটি বন্ধ ছয় বছর ধরে। বাকিটির কাজও অসমাপ্ত। উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) থাকা তিনটি পশু জবাইখানার একটি বন্ধ। চালু থাকা বাকি দুটির অবস্থাও নাজুক। দুই বছর ধরে নেই কোনো ভেটেরিনারি সার্জন। আর এসব কারণে স্বাস্থ্যপরীক্ষার ফিটনেস সনদ ছাড়াই দুই সিটিতে মাংস বিক্রি হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের জবাইখানা বন্ধ থাকলেও রাজধানী জুড়ে প্রতিদিন হাজারো পশু জবাই হচ্ছে যত্রতত্র। বাজারকেন্দ্রিক দোকানগুলোর পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার মাংসের দোকানেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দেদারসে পশু জবাই হচ্ছে।
ঢাকায় প্রতিদিন কতগুলো গরু-ছাগল জবাই হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জবাইখানায় ৮৯ হাজার ৭৪২টি গরু-ছাগল ও মহিষ জবাই করা হয়েছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩৫টি গরু, সাতটি মহিষ ও ৭৮০ থেকে ৮০০ ছাগল, খাসি ও ভেড়া জবাই করা হয়।
জবাইখানার বাইরে যে পশুগুলো জবাই হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। মাংস বিক্রেতা সমিতির কাছেও নেই এর সঠিক পরিসংখ্যান। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর মাংস বিক্রেতা সমিতিগুলোও বিভক্ত হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ফলে রাজধানীতে জবাই হওয়া পশুর পরিসংখ্যান পাওয়া আরও দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
ডিএসসিসিতে ১০ জন ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও ২০ জন ভেটেরিনারি পরির্দশক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ছয়জন। আর ডিএনসিসিতে কোনো ভেটেরিনারি সার্জনই নেই। ভেটেরিনারি পরিদর্শকও আছেন মাত্র একজন।
জনবল সংকেটের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি অফিসাররা। ডিএসসিসির ভেটেরিনারি অফিসার শরণ কুমার সাহা বলেন, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দক্ষিণ সিটির ১০টি অঞ্চলের সব বাজারে মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনজন ভেটেরিনারি সার্জন ও তিনজন পরিদর্শক পালা করে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বলেন, জবাইখানা চালু হলে নগরবাসী উপকৃত হবেন। সেখানে আধুনিক ল্যাব ফ্যাসিলিটি রয়েছে। তখন নগরবাসী কোয়ালিটি মিট পাবেন।
ডিএনসিসির অঞ্চল-১-এর ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমানও জনবল সংকটের কথা তুলে ধরে বলেন, নগরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত মাংস নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনে জনবল নিয়োগ করা দরকার। এর বিকল্প নেই।
কয়েকদফা দরপত্র আহ্বান করেও হাজারীবাগে নির্মিত ডিএসসিসির আধুনিক জবাইখানার ইজারা হয়নি। এ অবস্থায় এবার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জবাইখানাটি চালুর কথা ভাবছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জবাইখানা চালুর বিষয়ে কয়েকদফা টেন্ডার আহ্বান করেও ইজারাদার পাওয়া যাচ্ছে না। জবাইখানাটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এজন্য তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আর কাপ্তানবাজারের জবাইখানাটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। কিছু কাজ বাকি রয়েছে।
ভেটেরিনারি সার্জনের সনদ ছাড়া মাংস বিক্রি ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে পশু জবাইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমএইচ চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশনের জবাইখানা বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার যত্রতত্র পশু জবাই করা হচ্ছে। পশু জবাই করতে হবে পরিচ্ছন্ন স্থানে। যারা জবাইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদেরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। একই সঙ্গে পশু জবাই ও মাংস কাটতে ব্যবহৃত যন্ত্র পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে।
তিনি বলেন, জবাইয়ের আগে পশু পরীক্ষা করতে হয়। দেখতে হয় যে ওই পশুর মাংস স্বাস্থ্যসম্মত কি না। অথচ তদারকির অভাবে রাজধানীর অনেক জায়গায়ই রোগাক্রান্ত পশু জবাই করা হচ্ছে। অসুস্থ পশুর মাংস খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পশু কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে ভোক্তাও তাতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই জবাইয়ের আগে পশুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাটা অত্যন্ত জরুরি।
আইনে যা আছে
নিরাপদ খাদ্য আইনের ৩৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য বা মৎস্যপণ্য অথবা রোগাক্রান্ত বা মৃত পশু-পাখির মাংস, দুগ্ধ বা ডিম দ্বারা কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ প্রস্তুত, সংরক্ষণ বা বিক্রয় করতে পারবেন না। প্রথমবার এ অপরাধ করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন থেকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নজরদারির অভাবে রাজধানীর মাংসের দোকানগুলোতে আইনের এই ধারার ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে। এসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নজরে পড়ে না। কোনো উদ্যোগ-অভিযান নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও।