হঠাৎ কোথাও আগুন লাগলে তা তাৎক্ষণিক নেভানোর জন্য ব্যবহৃত ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের বাজারমূল্য ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে এ যন্ত্র কেনা হয়েছে ১৫ হাজার টাকার বেশি দরে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে মাত্র ১০-১২টি করে যন্ত্র কেনা হয়েছে দেড় লাখ টাকায়। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে মোট ১৮ লাখ টাকা খরচ দেখিয়ে কেনা হয়েছে মাত্র ১৫০টির মতো ফায়ার এক্সটিংগুইশার, যার প্রকৃত বাজারমূল্য দুই লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুন থেকে রক্ষার নামে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট করা হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি দাম পড়েছে।
পুরান ঢাকার নবাবপুরে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ কেজির এবিসি টাইপ ফায়ার এক্সটিংগুইশারের দাম দোকানভেদে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং সিও২ টাইপের দাম ২ হাজার ৬০০ টাকার মতো। কিন্তু কেরানীগঞ্জের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনগুলোতে স্থাপিত ফায়ার এক্সটিংগুইশারের সংখ্যা অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, ৯০০ টাকার একটি যন্ত্রের দাম পড়েছে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
দেশ রূপান্তরের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের টিআর কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় ধাপে কেরানীগঞ্জ উপজেলায় ১ কোটি ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপনের জন্য দেড় লাখ টাকা করে মোট ১২টি ইউনিয়নে ১৮ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
প্রতিটি ইউনিয়নে দেড় লাখ টাকা খরচ দেখানো হলেও সরেজমিনে কেরানীগঞ্জের ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ভবনে মাত্র ১০-১২টি ৫ কেজির ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া আর কিছুই স্থাপিত হয়নি। এ হিসাবে প্রতিটি যন্ত্রের দাম পড়েছে ১২-১৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক ও সচিবরা একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন।
বাস্তা ইউনিয়নের সচিব মো. মোস্তফা বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপক প্রকল্প থেকে আমরা ১২টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া আর কিছু পাইনি।’
১২টির দাম দেড় লাখ টাকা কি নাজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। মূলত যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেই পরিমাণ যন্ত্র তো আসেনি। বরাদ্দের সঙ্গে জিনিসপত্রের কোনো মিল নেই। বিষয়টা উপজেলা পিআইও অফিস ভালো বলতে পারবে।’
শুভাঢ্য ইউনিয়নের প্রশাসক সাত্তার বেগ বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তার জন্য আমাদের ইউনিয়নে ১০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেওয়া হয়েছে।’ ১০টির দাম দেড় লাখ টাকা কি নাপ্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মূলত এটা উপজেলা প্রকল্প অফিস থেকে কেনা হয়েছে। সব ইউনিয়নেই একই। আমরা টেন্ডার বা ওপেন কিছুই করিনি। এটা প্রকল্প অফিসের প্রকল্প। তারাই ঠিকাদার দিয়ে সব করেছে। এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না।’
কোন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পটা সাবেক ইউএনও রিনাত ফৌজিয়া ম্যাডাম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার ভালো বলতে পারবেন। পুরো প্রকল্পটা তাদের মাধ্যমেই হয়েছে। ক্রয় পরিকল্পনা বা ক্রয়পদ্ধতির সঙ্গে আমরা কেউ জড়িত ছিলাম না।’
যে প্রতিষ্ঠান থেকে এই ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেনা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেই পুরান ঢাকার নবাবপুরের ‘এ আর কে ফায়ার ফাইটিং ম্যানুফ্যাকচার’-এ গিয়ে কথা বললে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রের দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে বলে জানান। কোম্পানির টেকনিশিয়ানরাও নিশ্চিত করেন, দাম ৯০০-১২০০ টাকা এবং সিও২ টাইপের দাম সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ টাকা। বাজারমূল্য যাই বাড়ুক, ২০০-৩০০ টাকার বেশি ওঠানামা করে না।
সরকারি টাকায় প্রকল্পের নামে এমন অনিয়ম ও লুটপাটের বিষয়ে জানতে কেরানীগঞ্জের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রাশেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে তিনি উত্তেজিত হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
সদ্য যোগদানকৃত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উমর ফারুকের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, অনিয়মের বিষয়টি তিনি জানেন না এবং খোঁজ নিয়ে পরে জানাবেন।