ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। রফিক, শফিক, জব্বারসহ অসংখ্য ভাষা শহীদের স্মরণে প্রতি বছরই বছরের দ্বিতীয় মাসে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। আজ জানুয়ারির ২৭ তারিখ। একুশে বইমেলা শুরু হতে আর সপ্তাহখানেক বাকি। ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হবে বাঙালির বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রাণের মেলা। মেলা প্রাঙ্গণ কবি, লেখক, সাহিত্যিক, বইপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর হবে আগামী শনিবার থেকে; কিন্তু এই গ্রন্থমেলা ঘিরে কয়েকমাস আগে থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়েছে রাজধানী পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রকাশনা ও ছাপাখানাগুলোয়। এখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই প্রকাশনা, ছাপাখানার কর্মীদের। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া ভুলে কয়েকমাসের জন্য বইয়ের কাজকেই ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নিয়েছেন বই সংশ্লিষ্টরা। দিনরাত এক করে কাজ করছেন তারা।
বাংলাবাজরের বিভিন্ন প্রকাশনা ও ছাপাখানায় এখন বই ছাপা ও বাইন্ডিংয়ে কাজে ভীষণ ব্যস্ত শ্রমিকরা। যেন দম ফেলার ফুরসতটুকুও নেই। তবে শ্রমিকদের বেশিরভাগ খণ্ডকালীন। যারা বছরের তিন মাস বই ছাপানোর কাজ করেন এবং বাকি সময়টা বেছে নেন অন্য পেশা। আছেন স্থায়ী শ্রমিকও। তবে খণ্ডকালীন হোক বা স্থায়ী শ্রমিক—কেউই পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুরান ঢাকায় শিংটোলার একটি ছাপাখানায় কাজ করছিলেন মো. মামুন। মামুন জানালেন, বইমেলা কেন্দ্র করে তিন মাসের জন্য অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তিনি স্থায়ী কর্মী হিসেবেই এ কাজ করেন। কাজে খাটুনি থাকলেও সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক নেই। দুর্ঘটনায় শিকার হলেও মালিকপক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না শ্রমিকরা। ছাপাখানাগুলোয় শ্রম অধিকার আইন মানা হয় না। আট ঘণ্টা কাজ করে মেলে মাসে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা। এ দিয়ে তো আর সংসার চলে না। তাই এই পেশা থেকে অনেকে সরে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ছাপাখানার একজন প্রহরীর পারিশ্রমিকও শ্রমিকের চেয়ে বেশি।
আরেক শ্রমিক হায়দার সিকদার ছাপাখানায় এখন কাজ করছেন বইমেলা ঘিরে। তিন মাসের জন্য তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগে ছাপাখানার স্থায়ী শ্রমিকই ছিলেন। কিন্তু করোনার সময় ছাপাখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন। ঢাকা ছাড়তে হয় তাকে। গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন। কিন্তু কৃষিকাজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। তাই আবারও ঢাকা এসে ছাপাখানায় প্রেসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, করোনার সময় আগে যে ছাপাখানায় কাজ করতেন, সেখানে মালিক বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। ওই কারখানা মালিক কাউকেই তিন মাসের বেতন দেননি। হায়দার আরও বলেন, টাকার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাপাখানায় প্রেসম্যানের কাজ করি। কিন্তু সে তুলনায় কোনো মূল্য আমরা পাই না।
শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানেন না বেশিরভাগ বই প্রকাশক। ছাপাখানাগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে বই ছাপান তারা। ফলে ছাপাখানার শ্রমিকদের শ্রম অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টিও জানেন না।
বাতিঘর প্রকাশনীর প্রকাশক মোহম্মদ নাজিমুদ্দিন জানান, আগে প্রকাশকরা ছাপাখানা নির্মাণ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন; কিন্তু এখন অধিকাংশ প্রকাশকের নিজস্ব ছাপাখানা নেই। ফলে তারা বিভিন্ন ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে প্রকাশনাগুলো পরিচালনা করা হয়। তবে তার প্রশ্ন, ‘কয়েকটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশে শ্রমিকদের ন্যায্যমূল্য কোন খাতে দেওয়া হয়? বাতিঘরেরও নিজস্ব কোনো ছাপাখানা নেই। আমার প্রকাশনাও অন্য একটি ছানাখানার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে বই ছাপায়।’
জলধি প্রকাশনার প্রকাশক নাহিদা আশরাফি বলেন, ‘২ কোটি টাকা দিয়ে ছাপাখানা নির্মাণ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব নয়। আমরা যাদের সঙ্গে কাজ করি, তারা কীভাবে তাদের কর্মীবাহিনী পরিচালনা করবে, সেটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে আমরা প্রকাশকরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আমি যেমন প্রুফ রিডিং থেকে প্রচ্ছদ তৈরি—সব নিজ দায়িত্বে করিয়ে থাকি। এখানে যারা কাজ করেন তাদের সমস্যাগুলো দেখতে পারি। কিন্তু ছাপাখানার মালিকরা তাদের শ্রমিকদের কীভাবে পরিচালনা করছেন, তাদের কী সমস্যা তা জানার এখতিয়ার আমার নেই।