ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই জোরালো হচ্ছে জোট গঠন ও আসন বণ্টন নিয়ে গোপন আলোচনা। পাশাপাশি বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্ভাব্য জোট গঠনের খবরে তরুণ রাজনীতিবিদদের একটি অংশের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। খোদ এনসিপির মধ্যেই এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। এতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়ে এই জোট গঠন নিয়ে।
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলন এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সমন্বয়ে আট দলের জোটেও ভাঙন ধরেছে। চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম এবং মাওলানা মামুনুল হক উভয়েই এমন আভাস দিয়েছেন যে, চাহিদামতো আসন না পাওয়ায় জামায়াতের সঙ্গে তাদের নির্বাচনী জোট থাকছে না।
এনসিপির অনেক নেতা জামায়াতের পরিবর্তে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতায় যেতে আগ্রহী। তারা মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোটে গেলে তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যাবে। এনসিপি একপর্যায়ে জামায়াতেই বিলীন হয়ে যাবে। দলটির শীর্ষ নেতারা কেউ কেউ আশা করছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনোই আগ্রহ দেখানো হয়নি এ পর্যন্ত। তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে গতকাল এনসিপির শীর্ষ নেতারা সবাই ছিলেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা আশা করছেন, শিগগিরই তারেক রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হবে এবং তাতে আসন নিয়েও আলোচনা তোলা যাবে।
জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা এনসিপির
এনসিপি নেতারা ইতিমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখেছেন, নির্বাচনী মাঠের অবস্থা তাদের মোটেই ভালো নয়। নবগঠিত এই দলটির নেতারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে অনুকূল পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা, আর নির্বাচন করে এমপি হয়ে আসা এক কথা নয়। নির্বাচনে আসন পাওয়া দূরের কথা, শীর্ষ নেতারা যেসব আসনে প্রার্থী হবেন অন্তত সেগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে হলেও বিএনপি অথবা জামায়াতের সহায়তা লাগবে। এর আগে বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপির সঙ্গে আসন নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলছিল। তাতে অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তাই তড়িঘড়ি করে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এনসিপি। কয়েকদিন ধরে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তার পর বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের বাসভবনে বৈঠক করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে ‘অসুস্থ নেতাকে দেখতে যাওয়া’ বলা হলেও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সেখানে আসন সমঝোতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, শুরুতে এনসিপি ৫০টি আসন দাবি করলেও দীর্ঘ দরকষাকষির পর তা কমে ৩০টি আসনে নেমে আসতে পারে। এই সমঝোতার আওতায় বাকি ২৭০টি আসনে এনসিপি কোনো প্রার্থী দেবে না এবং জামায়াতকে সরাসরি সমর্থন করবে— জামায়াতের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাবও আলোচনায় রয়েছে। বিনিময়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে আসনপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্বাচনী ব্যয় বহনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। যদিও বিষয়টি কোনো পক্ষই প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের আলোচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি এই প্রচেষ্টাকে ‘তারুণ্যের রাজনীতির কবর রচনা’ এবং ‘স্বার্থ হাসিলের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’ হিসেবে আখ্যা দেন। তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এদিকে এনসিপির অভ্যন্তরে নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ অবস্থান নিয়ে সমঝোতার আলোচনা চলছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। অসমর্থিত সূত্রগুলোর দাবি, সম্ভাব্য জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে বিরোধী দলে গেলে বিরোধী দলীয় নেতা করার বিষয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। অবশ্য, এ ধরনের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে জামায়াত মোটেই রাজি নয় বলে জানা গেছে।
দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এককভাবে লড়াই করার সক্ষমতা নেই। জোটের মাধ্যমে টিকে থাকাই এখন প্রধান লক্ষ্য।
জামায়াতের কৌশল ও আসন জরিপ
আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী কিছু কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। দলটি তিনটি বিশেষ জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, অনেক মিত্র দল এমন আসন দাবি করছে— যেখানে তাদের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল এবং পরাজয়ের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ওই আসনগুলোতে জামায়াতের শক্তিশালী প্রার্থী ও ভোটব্যাংক রয়েছে বলে দাবি দলটির।
জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “আমরা শুধু জোটের স্বার্থে নিশ্চিত পরাজয়ের ঝুঁকি নিয়ে আসন ছাড়তে রাজি নই। প্রার্থীর পরিচিতি, এলাকার রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাংগঠনিক শক্তিও— এই তিনটি বিষয়ই আমাদের বিবেচনায় প্রধান “
সূত্রমতে, জামায়াত নিজে দুই শতাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এনসিপি, এবি পার্টিসহ অন্য মিত্রদের জন্য প্রায় ৮০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার একটি খসড়া পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্যান্য ইসলামী দলের অনড় দাবি
জোট আলোচনায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১০০টি আসনের দাবি থেকে সরে আসতে রাজি নয়। শুরুতে তারা ১২০টি আসনের দাবি জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস অন্তত ২৫টি আসনের দাবি জানিয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে।
এই দলগুলোর কয়েকটি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, দাবি পূরণ না হলে তারা সমঝোতা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফলে ইসলামী জোটের ভেতরেই তৈরি হচ্ছে নতুন করে চাপ ও অনিশ্চয়তা।
তরুণ রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সম্ভাব্য জোট তরুণ রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একটি অংশ মনে করছে, এটি বাস্তববাদী রাজনীতি; অন্য অংশের কাছে এটি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার উদাহরণ।
সব মিলিয়ে, আসন বণ্টন ও জোট রাজনীতিকে ঘিরে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা আগামী দিনে দেশের ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণের চিত্রও স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষনিউজ