Image description

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব জসীমউদ্দিন (ছদ্মনাম)। চিকিৎসকের পরামর্শে বছরখানেক ধরে রাতের আহার শেষে রমনা পার্কের পাশের ফুটপাতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতেন তিনি। তবে সপ্তাহ দুয়েক ধরে এটি বন্ধ করে দিয়েছেন। কেন? জসীমউদ্দিন জানান, হাঁটাহাঁটি করতে বের হলে সঙ্গে সাধারণত টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন থাকে না। অর্থাৎ ছিনিয়ে নেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছু না পেলে বরং ছিনতাইকারীরা আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। এই ভয়ে তিনি এখন আর রাতে হাঁটাহাঁটি করতে বের হচ্ছেন না। এ ছাড়া চারদিকে ছিনতাইয়ের খবরে তার পরিবারও আতঙ্কিত। রাতে হাঁটতে বের হলে পরিবার টেনশনে থাকায় সব মিলিয়ে হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে দিয়েছেন।

শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকার আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে স্ট্রোকে আক্রান্ত স্বজনকে নিয়ে এসেছিলেন লিয়াকত হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তার একার পক্ষে রোগী ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এরপরও তিনি কোনো স্বজনকে সাহায্যের জন্য ডাকেননি।

বরং মোবাইল ফোনে এক স্বজনকে বলছিলেন, ঢাকার রাস্তা ভয়ানক। রাস্তায় বের হলেই ছিনতাই হচ্ছে। এত রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাত নামতেই অলিগলি থেকে রাজপথের অধিকাংশ এলাকা চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি স্থানে ছিনতাই নগরবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। রাতের ঢাকায় টহল পুলিশের দেখা কম মেলায় বেড়েছে নিরাপত্তাহীনতা, বেড়েছে আতঙ্কও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে গ্রেপ্তার চললেও ছিনতাই কমছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশের মনোবল ও তৎপরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারাগার থেকে অপরাধীরা ঢালাওভাবে বের হচ্ছে। যৌথ বাহিনীর জোরালো সাঁড়াশি উদ্যম নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া ডাকাতি-ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না থাকায় এ ধরনের অপরাধ থামছে না।

ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী-ডাকাত দল ছিনিয়ে নিচ্ছে অর্থ ও মালামাল। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতে রাজধানীর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী সজল রাজবংশীকে গুলি করে ৭০ ভরি সোনা ও নগদ চার লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ডাকাত দল। ভুক্তভোগী সজল কামরাঙ্গীরচরের ইতি জুয়েলার্সের মালিক। কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ট্রাফিক বক্স এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল ডাকাত দল। প্রতিদিনের মতো স্বর্ণ ব্যবসায়ী সেখান দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে যাওয়ার সময় গুলি করে ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীর গুলশান-২ ইসিজি মার্কেটের সামনে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের শিকদার (৩০) ও তার মামাতো ভাই আমির হামজাকে (২৫) কুপিয়ে ৮০ লাখ টাকাসহ ডলার ও ইউরো ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।

গত শুক্রবার দিবাগত রাতে মিরপুর সিটি কলোনি এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করায় মো. মিলন (২২) নামের এক পোশাক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে ঢাকার বিজয়নগর পানির ট্যাংকের কাছে সাজু মোল্লা নামে এক প্রাইভেট কার চালক ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। পরদিন মঙ্গলবার রাতে মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে টিপু মিয়া নামে এক প্রাইভেট কার চালককে ছুরিকাঘাত করে ২৮ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। গত বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে অছিম পরিবহনের একটি বাসে যাত্রীবেশে ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত যাত্রীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেছেন, শিগগিরই মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে পুলিশ। পুলিশের ভয় কেটে যাবে; পুলিশ যাতে মানুষের বন্ধু হিসেবে কাজ করতে পারে সেই চেষ্টা করছে সরকার।

ডিএমপির এসআইভিএসের (সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম) তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত প্রায় ৩ হাজার ২০০ জন। জানা গেছে, এ পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবে ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িত অপরাধীর সংখ্যা আরও বেশি। প্রতিদিন নতুন নতুন মুখ ছিনতাইয়ে যুক্ত হচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাতের ঢাকায় ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের সক্রিয়তা কম। টহল পুলিশের দেখাও মেলে না। আবার ছিনতাই হওয়া অর্থ ও মালামাল উদ্ধারের নজিরও কম। ফলে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইকারী ধরতে তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। প্রতিদিনই ঢাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাত গ্রেপ্তার হচ্ছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ১০ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বনানীতে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় দুই সেনাসদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে বনানী থানা পুলিশ।