একেই তো ওষুধের দাম বাড়তে বাড়তে চলে গেছে নাগালের বাইরে, তার মধ্যে আবার বেড়েছে ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা। বাজারে আসল ওষুধ আর ভেজাল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করাই কষ্টকর। শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল, সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ, যা নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে ভেজাল ও নকলের উপদ্রব এতটাই বেড়েছে যে, চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে ওষুধগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ বন্ধও করে দিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শুধু ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের। ঢাকার বাইরে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। অনেক ক্ষেত্রে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি বিক্রির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সবখানেই ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব ওষুধের চাহিদা এবং দাম বেশি, সেগুলোরই নকল ও ভেজাল বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে।
গবেষণাটিকে তারা দুভাগে ভাগ করছেন, যেখানে প্রথমভাগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন ধরনের গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ১৮৯টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর মান পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকরা। সেগুলো হলো : ইসোমিপ্রাজল, সেফিক্সিম এবং অ্যামোক্সিসিলিন-ক্লাভুলানিক অ্যাসিড। এর মধ্যে ইসোমিপ্রাজল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিরসনে ব্যবহার হয়। আর সেফিক্সিম এবং অ্যামোক্সিসিলিন-ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মূলত অ্যান্টিবায়োটিক, যা সাধারণত নিউমোনিয়া ও প্রস্রাবের সংক্রমণের মতো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
নমুনাগুলোর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাদের থেকে এবং ২০ দশমিক ৯ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় ওষুধের পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে। গবেষণাটির প্রধম ধাপের ফলাফলে প্রকাশিত হয়। সেখানে ঢাকায় সংগৃহীত নমুনায় নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।
গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিকে ওই তিন ধরনের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে ঢাকার থেকে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশের মতো নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ পেয়েছেন গবেষকরা। নকল ওষুধের কোনো কোনোটির মধ্যে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দাও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বাংলাদেশে যেসব ওষুধের নকল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দা, এমনকি সুজি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।
২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে আটা, ময়দা এবং সুজি ব্যবহার করে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী একটি দলের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে তখন বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৫ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। দলটির সদস্যরা প্রায় ১০ বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করে আসছিল বলে জানান পুলিশের কর্মকর্তারা। নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন মাধ্যমে ওষুধগুলো পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকার অলিগলির ফার্মেসি থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। আবার অনেক সময় কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় রোগীরাও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির মধ্যে বড় একটা অংশেরই অনুমোদন নেই বলে জানা যাচ্ছে। আবার যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, নজরদারির অভাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক ফার্মেসি নিয়ম-নীতি মানছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
বিশেষ করে, মফস্বল শহর ও গ্রামে যে ফার্মেসিগুলো গড়ে উঠছে, সেগুলোর বেশির ভাগই দেখা যাচ্ছে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। ওষুধ সংরক্ষণের মতো পরিবেশও অনেকগুলোতে নেই। অথচ ওষুধ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের পরিবেশের প্রয়োজন হয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ওষুধের গায়েই লেখা থাকে যে সেটি কেমন পরিবেশে এবং কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। সেজন্য ফার্মেসিতে এসি এবং ফ্রিজ রাখাটা জরুরি। কিন্তু আমরা তো দেখছি যে, ঢাকার বাইরে, এমনকি ঢাকার ভিতরেও অসংখ্য ফার্মেসিতে সেগুলো নেই। এতে অনেক ওষুধের মান নষ্ট হচ্ছে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়াকে জাতীয় স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ‘টাকা খরচ করে এসব ওষুধ কিনে মানুষ কেবল প্রতারিতই হচ্ছে না, বরং এর ফলে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে; এমনকি অনেকে মারাও যাচ্ছেন,’ জানালেন একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ দুভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। এর মধ্যে কিছু তাৎক্ষণিক ক্ষতি হচ্ছে, আর কিছু হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। তাৎক্ষণিক ক্ষতিটা হলো রোগীর ভোগান্তি। আটা-ময়না দিয়ে বানানো নকল ওষুধ যেহেতু কাজ করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে রোগ সারছে না। অন্যদিকে, যেগুলোতে রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, সেগুলোর কারণে দীর্ঘমেয়াদে রোগীর শরীরে নতুন নানান স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। আবার গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে নকল-ভেজাল ওষুধ মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত বছর ঢাকার বেশ কিছু হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দেওয়ার পর অন্তত তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়। পরে চেতনানাশকে ব্যবহৃত ‘হ্যালোথেন’ পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন যে, সেগুলোতে ভেজাল ছিল।
এ ঘটনার পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে চেতনানাশক ওষুধ হিসেবে হ্যালোথেনের ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও নিম্নমানের ওষুধে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি করছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
ঢাকায় ওষুধের বড় পাইকারি বাজার মিটফোর্ড এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি কম দেখা যায়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ বাহিনীকে আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসনকেও সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এ সুযোগে তারা আবার ব্যবসা শুরু করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ঢাকা ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় নতুন করে নকল ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়েছে। কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর এলাকায় কারখানা আছে শুনছি।
কারা এসব নকল ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ বিক্রেতাদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে তো দেখা যেত সরাসরি মার্কেটে দিত। কিন্তু এখন বিক্রি করে অনলাইনে। আবার কুরিয়ারও করে পাঠায়। এভাবে সারা দেশে ছড়াচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ উৎপাদনকারী ৩০২টি কোম্পানির নাম তালিকাভুক্ত হলেও ২২৯ কোম্পানি নিয়মিত ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে। নানা অনিয়মের অভিযোগে ৬৩ কোম্পানির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ, দুটি কোম্পানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। মার্কেটে শুধু ২০-২৫টি কোম্পানির ওষুধ পাওয়া যায়। অর্ধশতাধিক কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ শতাধিক দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এসবের বাইরে অন্য কোম্পানিগুলো কি ওষুধ বিক্রি করছে তা বিক্রেতারাও জানেন না। ওইসব কোম্পানির নিম্নমানের ভেজাল ও নকল ওষুধের দাম কম। ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বাজার উপজেলা থেকে গ্রামাঞ্চলে সর্বাধিক।
নকল ও ভেজাল ওষুধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, বেশির ভাগ কোম্পানির ওষুধ তৈরির কাঁচামাল নিম্নমানের। এর মধ্যে আবার ভেজাল ও নকল করা হয়। এসব ওষুধ স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।