Image description

পিলখানায় মাত্র ৩৬ ঘণ্টায় সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, এটি কি কেবল একটি বিদ্রোহ ছিল, নাকি এর পেছনে ছিল সুপরিকল্পিত একটি ভূরাজনৈতিক অপারেশন? রাষ্ট্রীয় নথি, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, সামরিক কর্মকর্তাদের জবানবন্দি, বিদেশি গবেষণা ও ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য মিলিয়ে উঠে আসে এক ভয়াবহ বাস্তবতা—বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের ভূমিকা ছিল নিবিড় এবং বহুমাত্রিক।

এই ঘটনায় একদিকে বিডিআরকে মেরুদণ্ডহীন ও অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত করা হয়, অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মনোবল, আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানা হয়। এসবের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী ছিল ভারত। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড থেকে পাঁচটি কৌশলগত সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিল দেশটি। পিলখানার বিদ্রোহ তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে এসব তথ্য উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের নিবিড় সম্পর্ক ছিল এবং এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভারত পাঁচটি সুবিধা অর্জন করতে চেয়েছিল। সেগুলো হলো—বিডিআরকে নেতৃত্বশূন্য করে একটি মেরুদণ্ডহীন ও অকার্যকর বাহিনীতে পরিণত করা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও নৈতিকতা ভেঙে দিয়ে পুরো বাহিনীকে দুর্বল করা, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানা এবং সামরিক বাহিনী ও বিডিআরকে ভারত-নির্ভরশীল করে তোলা।

বিদেশি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রতিবেদনে একাধিক তথ্য তুলে ধরা হয়। ২০০৮ সালের জুনে মেজর নাসির উদ্দিন বরিশালে ডিজিএফআইয়ের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুস সালামের সঙ্গে দেখা করে জানান, তিনি সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছেন এবং একই বিমানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে দেখেছেন, যারা ভারতের বারাসাতে ‘র’-এর সঙ্গে বৈঠক শেষে দেশে ফিরছিলেন। সেখানে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহসহ আরো কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। মেজর নাসির জানান, ওই বৈঠকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বড় ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং লক্ষ্য ছিল আগামী ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সেনাবাহিনী যেন নৈতিকভাবে দাঁড়াতে না পারে, সে রকম আঘাত হানা।

২০০৮ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন টুরিস্ট ভিসার জন্য ভারতীয় হাই কমিশনে গেলে সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় সেখানকার কর্মকর্তা নিরাজ শ্রীবাস্তবের। নিরাজ তাকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ এবং পাকিস্তানের দর্শন অনুসরণ করে; বাংলাদেশ আর্মি, নেভি ও এয়ার ফোর্সের ডকট্রিন পাকিস্তানের মতোই। এরপর তিনি পদুয়া প্রসঙ্গে বলেন, সেখানে বিডিআর ১৬–১৭ জন বিএসএফ সদস্যকে হত্যা করেছে এবং মন্তব্য করেন, ‘পদুয়া উইল নট গো আনচ্যালেঞ্জড অ্যান্ড আনপানিশড’। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নিরাজ শ্রীবাস্তব ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশনে মিনিস্টার পদে কর্মরত ছিলেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নায়েক মো. শহীদুর রহমান তার ঘনিষ্ঠ তোরাব আলীর বরাতে জানান, ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠকের পর পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয় এবং সমন্বয়ের জন্য শেখ ফজলে নূর তাপসের বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, লেদার লিটন ও তোরাব আলী উপস্থিত ছিলেন। অফিসারদের হত্যার কথা উঠলে তোরাব আলী আপত্তি জানিয়ে বলেন, অফিসারদের হত্যা করা যাবে না।

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌনে ১০টা থেকে ১০টার মধ্যে সাবেক এমপি গোলাম রেজা পিলখানা এলাকায় নর্দার্ন মেডিকেল কলেজের কাছে আলাউদ্দিন নাসিম, সাবেক এমপি মোর্শেদ, শেখ সেলিম এবং ‘র’-এর চার-পাঁচজন সদস্যকে দেখেন, যাদের তিনি আগে থেকেই চিনতেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক এ এমপি পিলখানার ভেতরে ও বাইরে কিছু লোককে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেন এবং কিছু মানুষকে ছোট টিনের ঘরে লাইফ জ্যাকেট খুলে রেখে পালাতে দেখেন। তাদের দেখে তার মনে হয়, তারা দেশের কেউ নয়।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে বিএসএফের যোগাযোগ ছিল এবং সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে বিএসএফের সহায়তায় ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় র‍্যাব গোয়েন্দা বিভাগ তথ্য পায় যে দুবাইগামী বিমানে বিডিআর সদস্য বা সন্দেহভাজনরা পালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা না পাওয়ায় ফ্লাইট আটকানো যায়নি।

২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে পিলখানার গেট খুলে কয়েকটি মাইক্রোবাস বেরিয়ে যায়। লে. কর্নেল (অব.) রওশনুল ফিরোজ একটি মাইক্রোবাসের দরজা খুলে ভেতরে ছয়-সাতজন মুখ ঢাকা লোক দেখতে পান। তাদের একজন ইংরেজিতে ‘হু’ বলে চিৎকার করে দরজা বন্ধ করতে বলেন। রওশনুল ফিরোজের ধারণা হয়, তারা বাংলাদেশি নন এবং সম্ভবত সামরিক ব্যক্তিত্ব।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী ছিল ভারত। ভারত এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। ২০০১ সালের পদুয়া-রৌমারি সংঘর্ষে বিএসএফ বিডিআরের কাছে পরাজিত হয়েছিল, যা ভারত কখনো মেনে নিতে পারেনি। নিরাজ শ্রীবাস্তবের ‘পদুয়া উইল নট গো আনচ্যালেঞ্জড অ্যান্ড আনপানিশড’ মন্তব্য, অভিনাশ পালিওয়ালের লেখায় ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রস্তুতির বিবরণ এবং ১৬ মার্চ ২০০৯-এ ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত সৌরভ শুক্লার ‘মোর দ্যান এ মিউটিনি’ প্রবন্ধ—সব মিলিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল।