Image description

বিদ্যমান অসৎ পন্থা, অযথা হয়রানি এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মানসিকতা নির্মূল করা না গেলে বিচার বিভাগ একদিন প্রান্তিক, অপ্রাসঙ্গিক ও অবিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা যদি ভেবে থাকি যে, বিচারপ্রার্থী জনগণের প্রতি অবহেলা করেও বিচার বিভাগ তার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারবে, তাহলে আমরা প্রকৃত অর্থেই এখনো বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করছি। আইন বৃহত্তর রাজনীতির একটা অঙ্গ হলেও, বিচারকদের রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস রপ্ত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বিদায়ি অভিভাষণে একথা বলেন বিচার বিভাগের প্রধান।

প্রধান বিচারপতির এ বিদায়ি অভিভাষণের সময় আপিল বিভাগের বিচারপতিরা, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছর ১০ আগস্ট হাই কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরদিন শপথ নিয়ে বিচার বিভাগের দায়িত্ব নেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েই প্রধান বিচারপতি ‘কার্যকর স্বাধীন বিচার বিভাগ’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।

সেই লক্ষ্যে ওই বছর ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেন তিনি। সেদিনের অভিভাষণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে স্বতন্ত্র-স্বাধীন বিচার বিভাগের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন।

এরপর বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন-বদলি ও শৃঙ্খলায় আচরণবিধি প্রণয়ন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নেন। সেই ধারাবাহিকতায় বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন অনেকে।

বিদায়ি অভিভাষণে এসব বিষয় তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহেমদ বলেন, সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি থাকার পরও এদেশের জনগণ কোনোদিন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। অর্জনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকেও বারবার ফিরে এসেছি। পৃথক সচিবালয়ের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরার পাশাপাশি বিচার বিভাগের প্রধান তার অভিভাষণে বিচারকদের উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, মানসম্মত আবাসন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্বে বিচার বিভাগ অসাংবিধানিক ক্ষমতা, অপশাসন ও রাষ্ট্রীয় কপট-কৌশলের অঘোষিত সহযোগী হয়েছে। দুঃশাসনের বলয়কে আবরণ দিয়েছেন অনেক বিচারক।

অন্যায়-অবিচারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিচারকদের এ নৈতিক বিচ্যুতি জনসাধারণকে শেষ পর্যন্ত জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার অন্যতম অনুঘটক।

প্রধান বিচারপতি বলেন, পৃথক সচিবালয় ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে এদেশের আপামর জনসাধারণের সাংবিধানিক সব অধিকার সুরক্ষিত করার প্রধান নিয়ন্ত্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবিধানের ৯৬(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ৬৭ বছরের পর আর বিচারক পদে থাকার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সে হিসাবে চলতি বছর ২৭ ডিসেম্বর তার ৬৭ বছর পূর্ণ হবে। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টে অবকাশকালীন ছুটি থাকায় ১৮ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতিকে বিদায়ি সংবর্ধনা দেবে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।