Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট। সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করা প্রত্যেক নাগরিকই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান। এ হিসাবে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত প্রায় ৫২ লাখ শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই এবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

এ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিভিন্ন সংষ্কারের দাবিতেও তারা ছিলেন সোচ্চার। রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণের সে ধারাবাহিকতায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়েও এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।

চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, দেশের উচ্চশিক্ষা স্তরে বিদেশী বাদে মোট শিক্ষার্থী ৫১ লাখ ৭৮ হাজার ১২০ জন। তাদের মধ্যে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩ জন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ৪৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৯ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আরো ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫৮৮ শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানেও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকায় মোট শিক্ষার্থী এর কাছাকাছি। উচ্চশিক্ষাঙ্গনের এ ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগে দল কিংবা প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীর যোগ্যতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ডকে বিবেচনায় নেবেন বলে বিভিন্ন নির্বাচনী জরিপে উঠে এসেছে।

 

vcbcvbcvb

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আজিজুল হক এবার প্রথম ভোট দেবেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভোটাররা বড় ভূমিকা রাখবেন বলে মনে করি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই রাজনীতি সচেতন এবং তাদের বড় অংশই প্রার্থীর যোগ্যতা ও কর্মকাণ্ড দেখে ভোট দেবেন বলে মনে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ সংগঠন দেখে ভোট দেননি। জাতীয় নির্বাচনেও এমনটি দেখা যেতে পারে।’

 

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের ভোটের সিদ্ধান্তে গুরুত্ব পাবে তরুণদের ভবিষ্যৎ জীবন ও সম্ভাবনা। অর্থাৎ বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট এবং তরুণদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা—এসব বিষয় মাথায় রেখেই তারা প্রার্থী নির্বাচন করবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশনের (জেইউডিও) সাধারণ সম্পাদক ফারিম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষা শেষে কাজের সুযোগ সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ডিজিটাল ও আধুনিক অর্থনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণের পথ দেখাতে পারা রাজনৈতিক শক্তিই মূলত তরুণ ভোটারদের সমর্থন পেতে পারে। একই সঙ্গে শাসন ব্যবস্থা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধী মতের প্রতি সহনশীলতা ও আইনের শাসনের বিষয়গুলোও সচেতন তরুণ ভোটারদের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই এবার তরুণরা ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে মার্কা অপেক্ষা ভবিষ্যৎকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন বলে আমি মনে করি।’

গত কয়েক মাসে চারটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল বেশ আগ্রহ-উদ্দীপনা। সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, ডাকসু নির্বাচনে ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ৬৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে ৬৯ দশমিক ৮৩ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ভোট পড়েছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। তবে এসব নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তুলনায় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীরাই বেশি জয় পেয়েছেন।

এবারের জাতীয় নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবেন বলে মনে করছেন ডাকসুর এজিএস মহিউদ্দিন খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভোটাররা সামগ্রিকভাবে রাজনীতি নিয়ে বেশ সচেতন। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম তারা খুব মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে আমরা মনে করি। তারা নিজের পরিবার থেকে শুরু করে আশপাশের মানুষদের ভোটকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম। ফলে আমরা মনে করি, তরুণদের অধিকাংশ ভোট যেদিকে যাবে জনগণের রায়ও ঠিক সেদিকেই হবে।’

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিগত চার সংসদ নির্বাচনের তুলনায় উচ্চশিক্ষা স্তরে অধ্যয়নরত ভোটার এবারই সবচেয়ে বেশি; ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় যা প্রায় চার গুণ। নবম সংসদ নির্বাচনের সময়ে উচ্চশিক্ষা স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৫৯ হাজারের মতো।

এবার কেবল সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট থাকায় রাষ্ট্র সংস্কারেও নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। এ কারণে তরুণদের মধ্যে এবারের ভোট নিয়ে আগ্রহ বেশি। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী খান মুহাম্মদ মামুন বলেন, ‘দেশে গত ১৫ বছর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এবারের নির্বাচন নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ রয়েছে। আর বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সংস্কার নিয়েও সোচ্চার ছিলেন তারা। এবারের ভোটে কেবল জনপ্রতিনিধি নির্বাচনই নয়, গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো সংস্কারেরও একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাই এ নির্বাচন নিয়ে তরুণরা বেশি আগ্রহী।’

ভোটারের পাশাপাশি এবার তরুণ প্রার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঘোষিত প্রার্থীদের বেশির ভাগই তরুণ। এছাড়া স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া অনেক তরুণ।

রাজনৈতিক দলগুলোও শিক্ষিত তরুণ ভোটারদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দল হিসেবে তরুণদের জন্য আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যেমন আধুনিক কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন, তরুণদের জন্য বিষয়ভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা, চাহিদামতো দক্ষ জনশক্তি রফতানি ইত্যাদি। তাছাড়া যারা ভালো গবেষক হতে চান তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমাদের দলের পক্ষ থেকে নেয়া হবে। আর এনসিপি এমন তরুণদের সম্মিলনে গঠিত নতুন একটি রাজনৈতিক দল, যারা জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই আমি বিশ্বাস করি তরুণরা এ বিপ্লবীদের পছন্দ করবেন।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সবার আগে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলটির ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীদের জয়ের ধারাবাহিকতায় এবার জাতীয় নির্বাচনেও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রার্থী দিচ্ছেন তারা। গুরুত্ব দিচ্ছেন তরুণ নেতৃত্বকে।

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থী ভোটারদের তারুণ্যের শক্তি হিসেবে দেখছি। শিক্ষাজীবন শেষে যাতে কারো বেকার থাকতে না হয় তা নিশ্চিতে আমরা নৈতিক-কারিগরি ও উৎপাদনমুখী সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করব। জয়ী হলে প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে আমাদের সরকার। আমাদের ইশতেহারেও রাষ্ট্র নিয়ে এ পরিকল্পনার কথা আমরা উল্লেখ করেছি। তরুণরাই হবেন আমাদের দেশ গঠনের আসল শক্তি। যেখানে যার আগ্রহ থাকবে সেখানেই যেন তিনি মেধা ও দক্ষতা প্রয়োগের সর্বোচ্চ সুযোগ পান, আমরা তেমন ব্যবস্থা করব।’

তিনি আরো বলেন, ‘চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনেও তরুণদের ভোটের ক্ষেত্রে তাদের এ মনোভাবের প্রভাব থাকবে বলে আমরা মনে করি।’

ক্ষমতায় গেলে ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটি কর্মসংস্থান এবং শিক্ষিত বেকারদের জন্য এক বছরের ভাতা চালুর অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে তরুণ ভোটারদের। তাই এবার দলটির ভোটের স্লোগান—‘তারুণ্যের প্রথম ভোট, ধানের শীষের জন্য হোক’।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরে প্রকৃত বাস্তবতা তরুণরা বুঝতে পারছেন। আমরা দেশ গড়ার পরিকল্পনা তুলে ধরছি, যেখানে তরুণদের নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষগুলো রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ করব। আমি মনে করি এসব বিষয়ে তরুণরা বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হবেন, যার মাধ্যমে তারা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সুন্দর একটি বাংলাদেশ পাবেন।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, দেশের মোট ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন শিক্ষিত তরুণ ও প্রথমবারের ভোটার। এ কারণে তাদের চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা বুঝে সময়োপযোগী নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণদের কাছে উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামো নয়; বরং তাদের জীবনযাত্রার মান, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার মতো বিষয়। প্রচলিত রাজনৈতিক ‘মার্কা’ বা ঐতিহ্যগত দলীয় আনুগত্যের বাইরে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, জীবনমান উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিয়েই হয়তো এবার তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা জেনজি’রা অনেক বুদ্ধিমান। তারা বুঝেশুনে সবকিছু চিন্তাভাবনা করেই ভোট দেবে। অন্যদিকে তরুণ প্রার্থীরাও অনেকে ভোটারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।’