Image description

দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি। খুন, মব সন্ত্রাস, চোরাগোপ্তা হামলা, আগুন, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি লাগামহীন। অপরাধীরা বেপরোয়া। এক পক্ষ আরেক পক্ষের প্রতি অসহিষ্ণু, মারমুখী। কেউ কাউকে মানছে না, ছাড় দিচ্ছে না। তিন দিন আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার মধ্য দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির চিত্রটি আরো স্পষ্ট হয়েছে। এতে সব মহলেই আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেড়েছে। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির ওপর সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ঘিরে আরো ভীতি ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কড়া নজরদারির প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। সংস্থাটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, সম্ভাব্য হামলার তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময় যাঁরা সম্মুখসারিতে ছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাঁদেরও অনেকে রয়েছেন।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি ও নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরাও এই তালিকায় রয়েছেন।

গতকাল রবিবার পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, এরই মধ্যে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ জনের নিরাপত্তাব্যবস্থায় দুজন আনসার সদস্য ও একজন করে পুলিশ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এর বাইরে অন্যদের বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে পুলিশ সুপারদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলছে অভিযান।
পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হবে।

এ বিষয়ে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাদির ওপর হামলার পর এরই মধ্যে অনেকে নিরাপত্তাহীনতার ভুগছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে আমরা সব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। অনেকের নিরাপত্তাব্যবস্থার দেখভাল শুরু হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের অভিযান চলছে।’

এরই মধ্যে জুলাইয়ের পক্ষের লোকদের ফোন করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে দাবি করে গতকাল দুপুরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে শরিফ ওসমান হাদির মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ডা. আব্দুল আহাদ দাবি করেন, ‘জুলাইয়ের পক্ষের লোকদের ফোন করে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের নম্বর পাবলিক করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পরিবার, আমাদের বাসার লোকেশনগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। এগুলোর আসলে শেষ কোথায়?’

এনসিপির ন্যাশনাল হেলথ অ্যালায়েন্সের (এনএইচএ) সদস্যসচিব ডা. আব্দুল আহাদ আরো বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এখনো হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এখন দেশে যে অবস্থা দেখছি, আমরা যারা অ্যাক্টিভিস্ট আছি, জুলাইয়ের পক্ষের যারা শক্তি আছি, আমাদের সবার জীবন হুমকির মুখে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর রাতে লক্ষ্মীপুর ও পিরোজপুরের নির্বাচন অফিসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। একই রাতে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটি চলন্ত বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গতকাল রাতেও উত্তর বাড্ডায় যাত্রীবাহী আগুন দেওয়া হয়। বাড্ডা থানার ওসি নাসিরুল আমিন বলেন, ‘এ ঘটনার তদন্ত চলছে। বেপরোয়া দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।’

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের সামনেও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। শেরেবাংলানগর থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ গত শনিবার রাতে রাজধানীর মৌচাক, মিরপুর ও শান্তিনগর এলাকায় চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর মধ্যে মিরপুর এলাকায় একজন আহত হয়। একই রাতে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক জনসংযোগের সময় এরই মধ্যে চট্টগ্রাম ও পাবনায় গুলির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ৫ নভেম্বর নির্বাচনী গণসংযোগ চালানোর সময় চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও দলের মহানগরের আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় একজন নিহত হন। আহত হন আরো দুজন। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও দলের জেলা আমির আবু তালেব মণ্ডলের জনসংযোগ ঘিরে হামলা, গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ছাড়া নির্বাচন হলে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণাও এসেছে। এরই অংশ হিসেবে এসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বলছে, এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিট ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‌্যাব) হামলাকারীদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেছে। তারা ঘটনার নেপথ্যে কারা আছেন, সেটি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখছে।

তফসিল ঘোষণার পর হাদিকে গুলি, বিভিন্ন স্থানে আগুন, ককটেল হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে জানিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘দেশের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

তফসিল ঘোষণার পরপরই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকার বৈঠক করেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়েছেন।

জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আবারও শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, এবার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২’। অনতিবিলম্বে তা শুরু করা হবে। এ ছাড়া জুলাই যোদ্ধাদের বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথাও জানান তিনি।

গত শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় এ কথা বলেন তিনি। সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গত বছরের জুলাই আন্দোলনে যাঁরা সম্মুখসারিতে ছিলেন, তাঁদের নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। এ জন্য আলাদা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সন্ত্রাস দমন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় অনতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছিল সরকার। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনে যাঁরা অংশগ্রহণ করবেন, তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়েও ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), চার নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের জন্য বাড়তি পুলিশি নিরাপত্তা (এসকর্ট) চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কাছে এসংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে ইসি।

জানা যায়, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। গতকাল রবিবার এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। বলা হয়, এই প্রটোকলে রাজনৈতিক নেতা এবং আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাঁদের বাসস্থান, কার্যালয়, চলাচল, জনসভা ও সাইবার স্পেসে কিভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে ওসমান হাদির গ্রামের বাড়িতে নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সকালে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় তাঁর বাড়িতে চুরির ঘটনার পর ওই বাড়িসহ আশপাশে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নলছিটি থানার ওসি আরিফুল আলম এই তথ্য দেন।

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। এরপর প্রায় দেড় বছর ধরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, হত্যা, গুলির ঘটনা বাড়তে থাকা, দলবদ্ধ সহিংসতার পাশাপাশি মবসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।