ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর দিনদুপুরে গুলি ও বিভিন্ন স্থানে আগুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরপরই এমন ঘটনায় এক ধরনের পরীক্ষার মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কারণ সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ইসির পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারেরও। তবে হাদির ওপর গুলির ঘটনাকে সরকার ও ইসি ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, এই হামলার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একই দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এদিন যুগান্তরকে বলেন, একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে যেভাবে গুলি করা হয়েছে তা সবার চোখ খুলে দেওয়ার মতো ঘটনা। তিনি এ ধরনের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখতে ইসির পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান।
তবে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির ওপর গুলি ও লক্ষ্মীপুরে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ২ দিনে রাজনীতিতে নানা আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ঘটনায় নির্বাচন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করছেন রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচন উপযোগী রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ নির্বাচনের আগে এ ধরনের ঘটনা আরও বড় হয়ে উঠতে পারে। তাই সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরদার ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তারা।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা অবিশ্বাস্য। এটি অবশ্যই সরকারের জন্য একটি পরীক্ষা। কারণ দিন-দুপুরে এ ঘটনা ঘটেছে। একেবারে ‘মেটিক্যুলাসলি ডিজাইন’ করে খুনিদের পাঠানো হয়েছিল। এখন আবার তাদের ধরতেও পারছে না। সরকারের কাছে তো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট থাকে। ফলে হাদির ওপর হামলায় ঘটনার দায় সরকারেরও আছে। কারণ আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, দেশের মধ্যে স্রোতের মতো অস্ত্র ঢুকছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ। পুলিশকে পুনর্গঠন করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন নাকি নাই, বুঝি না। এমন পরিস্থিতি থাকলে তো মানুষ ভোট দিতে যেতে ভয় পাবেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একতা নেই। ফলে শুধু সরকারকে দোষ দিলেই হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাও রয়েছে। এভাবে চললে তো দেশ সংকট থেকে বের হতে পারবে না। আর এরকম সহিংসতা চলতে থাকলে এই নির্বাচনে প্রথমত প্রার্থীরা ক্যাম্পেইন করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। সুতরাং সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকেই সব পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা একেবারে কাম্য নয়। তবে এটা বড় ধরনের উদ্বেগেরও ব্যাপার। অতীতে নির্বাচনের আগে কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে এবারের পরিস্থিতিটা নাজুক। তাই সরকারের এ ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি থাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড আমরা দেখতে পাইনি। চুরি ও লুট হওয়া গোলাবারুদ উদ্ধারেরও কোনো বড় ধরনের চেষ্টা করা হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাটতি আছে। তারা যদি এখনই এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটতে পারে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনি পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। যেসব বাহিনী এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আছে, তাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের জন্যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র সিঁড়ি হচ্ছে এই নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া দেশে সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা কোনোভাবেই ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং গ্রহণযোগ্য করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচন উপযোগী রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তার মতে, ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শরিফ ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আসন্ন নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরাজিত শক্তি পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা প্রতিনিয়ত হুমকি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। তাই অপশক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী যুগান্তরকে বলেন, এখানে দুইটা বিষয় আছে। একটা হচ্ছে, নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করে তোলা। জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলা। আরেকটা হচ্ছে জুলাই যোদ্ধাদের ‘কিলিং টার্গেট’ করা হচ্ছে কিনা। তবে নির্বাচনের জন্য এ ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। আমরা তো এটা অনেকদিন ধরে বারবার বলে আসছিলাম। কিন্তু উন্নতি হয়নি। উন্নতি হলে একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে তফসিলের পরদিনই গুলি করা হলো কীভাবে!
তিনি আরও বলেন, প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো ইসির এবং সরকারের। ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বও তাদের। ফলে ইলেকশন কমিশনকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত ধরতে হবে। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এগুলো না করতে পারলে নির্বাচনের জন্য সুখকর কিছু হবে না।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে নেমেছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত থাকার কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না গণ-অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া দল আওয়ামী লীগ। নিবন্ধন বাতিল না হলেও ১৪ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলগুলো এবং জাতীয় পার্টি নির্বাচনি মাঠে এখনো তেমন দৃশ্যমান হয়নি। অন্যদিকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দূরত্ব বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণার পরেও নির্বাচন শঙ্কা দূর হচ্ছে না। ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় এ শঙ্কা আরও বেড়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অংশগ্রহণ না থাকায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকরা নির্বাচন বানচাল করতে চাইবে এমন আলোচনা রাজনীতিতে আগেই ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো; নানা ইস্যুতে গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে। অনেকের মতে, এ কারণে আওয়ামী লীগ ও ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী শক্তি ‘স্পেস’ পেয়েছে। যে কারণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই ওই শক্তি সক্রিয় হয়েছে।