Image description
 

দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত। বলা যায়, পুরো দেশ এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল মাঠে তৎপর। এরই মধ্যে ৩০০ আসনের সবকটিতেই দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে বেশ কয়েকটি দল। আংশিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে আরও কয়েকটি দল। এ ছাড়া নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহীরাও নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির মানদণ্ডে এই মনোনয়ন তালিকাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের প্রাথমিক ধাপে দলগুলোর মধ্যে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের তুলনামূলক চিত্রে যে বৈসাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং অন্তর্ভুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী—বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটের মনোনয়ন তালিকাগুলো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের মেরূকরণকে ইঙ্গিত করছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে গতকাল পর্যন্ত দুই দফায় ২৭৩টি আসনে বিএনপি ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে নারী ১১ জন। এনসিপি ঘোষিত ১২৫টি আসনের মধ্যে নারী মনোনয়ন পেয়েছেন ১৪ জন। তবে জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন সমমনা ৮টি দলের প্রার্থী তালিকায় নেই একজনও নারী। যদিও বিষয়টি প্রাথমিকভাবে আলোচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীসহ এই আটটি দলের শীর্ষ নেতারা। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নারীদের জন্য ‘নিরাপদ আসন’ বরাদ্দ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বা কঠিন আসনগুলোতে নারী প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখতে দ্বিধা করছে। এর ফলস্বরূপ, সংসদীয় রাজনীতিতে নারীর প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ কী বলছে: দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। সে হিসেবে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারী এবং পুরুষের সংখ্যার অনুপাত অন্তত সমান সমান থাকার কথা। কিন্তু, তা নেই। প্রত্যাশাও এত বেশি না। ২০০৮ সালের (সংশোধিত ২০২০) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, দলের সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দলের বিভিন্ন স্তরে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনা মূলত দলীয় কমিটি গঠনের জন্য প্রযোজ্য হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরাসরি নারী প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলগুলোর নৈতিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটুকু, তা এই তালিকাগুলো দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৩৩ শতাংশের আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে দূরে থাকলেও, জাতীয় সংসদে ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসনে নারী মনোনয়ন দেওয়া দলগুলোর জন্য কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এবারের মনোনয়ন চিত্র প্রমাণ করছে, বৃহৎ দলগুলো এখনো সেই লক্ষ্য পূরণের পথে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

 

নারী প্রার্থী মনোনয়নে কোন দলের কী অবস্থা: ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশ আগেভাগেই অনেকগুলো দল তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিসসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতিমধ্যে ২৭৩টি আসনে তাদের আংশিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এই সুবিশাল তালিকার বিপরীতে নারী প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ১১ জন। শতাংশের হিসাবে, এই হার একটি প্রধান দল হিসেবে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। যদিও বিএনপির দীর্ঘদিনের ইতিহাসে নারী নেতৃত্বের শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে, তবুও মাঠ পর্যায়ে নারী কর্মীদের সংসদ নির্বাচনের মূল স্রোতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের এই দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। তুলনামূলকভাবে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করেছে। দলটি গতকাল পর্যন্ত তাদের ঘোষিত ১২৫টি আসনের বিপরীতে ১৪ জন নারী নেত্রীকে মনোনয়ন দিয়েছে। আসন সংখ্যার দিক থেকে ছোট হলেও এনসিপি নারী নেতৃত্বকে মূল্যায়নে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছে, তা বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। এনসিপির এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে, সংখ্যা নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই নারী অন্তর্ভুক্তির মূল চালিকাশক্তি।

 
 

জামায়াতসহ সমমনা ৮ দলে শূন্য নারী প্রার্থী : জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন সমমনা ৮টি দলের জোটের চিত্রটি নারী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই জোট এখন পর্যন্ত কোনো নারী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। শূন্য শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব তাদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সুস্পষ্ট প্রতিফলন। যদিও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বিষয়টি জোটের অভ্যন্তরে প্রাথমিকভাবে আলোচনায় রয়েছে। কিন্তু মনোনয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও নারী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে না পারা তাদের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি অনড় থাকার ইঙ্গিত দেয় বলে অনেকেই মনে করেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে নারীর ভূমিকাকে সীমিত করে দেখার যে প্রবণতা ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান, জামায়াত-নেতৃত্বাধীন জোটের এই সিদ্ধান্ত সেই পুরোনো চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে সব নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত, সেখানে একটি বৃহৎ জোটের নারী প্রার্থী শূন্য তালিকা দেশের প্রগতিশীল সমাজ এবং নারী অধিকার আন্দোলনের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। এ ধরনের জোটের মনোনয়ন তালিকা দেশের গণতন্ত্রকে কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল করতে পারে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

 

শুধু তাই নয়, জামায়াতসহ সমমনা ৮ দলের মনোনয়ন তালিকায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম বা অনুপস্থিত। বিশেষ করে জামায়াতের মতো আদর্শিকভাবে রক্ষণশীল দল এবং তাদের জোটের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি কোণঠাসা অনুভব করতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে তাদের স্বার্থ ও অধিকারের প্রতিফলন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে না-ও ঘটতে পারে।

রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবেই এক প্রকার প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। তারা প্রায়ই প্রধান দলগুলোর ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে বিবেচিত হলেও সরাসরি আইন প্রণয়নকারী বা সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলগুলো সব সময়ই রক্ষণশীলতা দেখিয়ে এসেছে। নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট হারানোর ভীতি অথবা কৌশলগত কারণে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এমন প্রেক্ষাপটে এনসিপি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাতজনকে মনোনয়ন দিয়ে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে। দলটির এই পদক্ষেপ শুধু অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির প্রতি তাদের অঙ্গীকারকেই শক্তিশালী করে না, বরং দেশের বৃহত্তর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবেও দৃশ্যমান হবে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দী নামে সনাতন ধর্মের একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে। আরও দু-একটি আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

নারী প্রার্থী নিয়ে ৮ দলের নেতারা যা বলছেন: নারী প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়া প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম কালবেলাকে বলেন, ‘নারীদের প্রার্থী করার বিষয়টি এখনো আলোচনায় আছে। কারণ, বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের নারী কর্মীদের অনেকেই নির্বাচনে আগ্রহী নন। আমাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী পাওয়া অন্য দলের তুলনায় কঠিন। কারণ, এখানে সংগঠনের নিয়মনীতির একটা বিষয় আছে। আবার তাদের পক্ষ থেকেও সাড়া পাওয়ার বিষয় রয়েছে। অন্য সংগঠনের প্রার্থী ও নারী প্রার্থী দেওয়া এটা দলের নতুন দিক।’

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের তো কোনো নারী প্রার্থী নেই। তবে জামায়াতে ইসলামী দেবে কি না জানি না। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের নারী প্রার্থী করার বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমাদের দলের নারী শাখা আছে। তবে আমাদের নারী কর্মীরা তো নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহী নয়।’

নানা কারণে তাদের দলের নারীরা নির্বাচনে আগ্রহী নন বলে উল্লেখ করেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখি কী করা যায়? এখনো আলোচনা হয়নি। নানা কারণেই আমাদের দলের নারীরা নির্বাচনে আগ্রহী নয়। কারণ হচ্ছে নির্বাচনে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, যা সবার জন্য সহজ নয়।’

৮ দল সমন্বিতভাবে কোনো প্রার্থী দেবে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

একই ধরনের ভাষ্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের। গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী তপশিলকে স্বাগত জানাই। সমমনা ৮টি দলের প্রার্থী বাছাই খুব শিগগির চূড়ান্ত হবে।’

তাদের দলে নারী এমপি প্রার্থী দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দলে কোনো নারী এমপি প্রার্থী নেই। তবে এ বিষয়ে চিন্তাও নেই। কারণ, নারীরা নির্বাচনে আগ্রহী নয়। ফলে কেউ আগ্রহী না হলে তার ওপর তো কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তার দল থেকে কোনো নারীকে প্রার্থী করার চিন্তাভাবনা নেই বলে জানান বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার। তিনি বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী করার বিষয়ে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। অন্য দলের থাকতে পারে।’

নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রার্থী করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা জানান জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় প্রধান ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান নারী। আর জাগপা এবার এককভাবে নয়, জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ফলে আমরা দলীয় প্রধানসহ মোট পাঁচজনের মনোনয়ন চেয়েছি। প্রথম দফায় আজ (গতকাল) জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আবারও দ্বিতীয় দফায় আলোচনা হলে সেখানে সমন্বিতভাবে নারী প্রার্থীসহ সংখ্যালঘুদের প্রার্থী করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’

এ ছাড়া এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি আনোয়ারুল হক চানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

ইসলামী দলগুলো নারীদের বিষয়ে রক্ষণশীল বলছেন বিশ্লেষকরা: বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন তালিকাগুলোর বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং লিঙ্গ-সমতাভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেশ দূরে অবস্থান করছে। এনসিপির মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দল নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে যে সাহস দেখিয়েছে, তা বৃহত্তর দলগুলোর জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। গণতন্ত্রের পরিপক্বতা শুধু নির্বাচন আয়োজনের মধ্যে নিহিত নয়; এটি নির্ভর করে সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ওপর। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে কেবল ভোটের কথা না ভেবে, সমাজের অর্ধেকের বেশি অংশ নারী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে আরও বেশি আন্তরিক হওয়া। অন্যথায়, দেশের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া সমাজের বৈচিত্র্যময় চিত্রকে ধারণ করতে ব্যর্থ হবে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হতে থাকবে।

জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোয় নারী এমপি প্রার্থী না থাকা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু আরপিও কেনো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে বিএনপি বলেছিল যে, কমপক্ষে ৫ শতাংশ নারী এমপি প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। কিন্তু সেখানে তারা ৩ শতাংশ দিয়েছে। একমাত্র এনসিপি নারীদের মনোনয়ন বেশি দিয়েছে। কিছুটা আমরা আশাও করি কারণ, এরা নতুন প্রজন্মের ছেলে-পেলে। এরা তো নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়তে চায়। সে রাষ্ট্রব্যবস্থায় তো নারীদের পার্টিসিপেশন (অংশগ্রহণ) প্রয়োজন।’

জামায়াতে ইসলামী নারীদের বিষয়ে অনেকটাই রক্ষণশীল মনোভব পোষণ করে উল্লেখ করে এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, ‘দলটি মেয়েদের ব্যাপারে অত্যন্ত কনজারভেটিভ (রক্ষণশীল)। তারা তো মনে করে যে, মেয়েরা ঘরে থাকবে। তাদের পাবলিক লাইফে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। এরকম একটা কনজারভেটিভ কট্টর মনোভাব আছে জামায়াতের। সুতরাং তারা যে নারী প্রার্থী দেয়নি কিংবা দিলেও একটা নামকাওয়াস্তে দেবে, তাতেও আমি আশ্চর্য নই। কিন্তু আমি বিএনপিরটাতে আশ্চর্য। কারণ, বিএনপি তো নিজেদের ক্লেইম (দাবি) করে যে, তারা একটা লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টি হলে নারীর পার্টিসিপেশন প্রয়োজন নেই। তারা বলল যে, মিনিমাম তারা ৫ ভাগ নারী মনোনয়ন দেবে। সেখানে তারা ৩-এর কম দিল। এটা বোঝা যায় যে, তারাও এ ব্যাপারে জামায়াতের থেকে খুব একটা দূরে নয়।’

ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আট দলীয় জোটে নারী প্রার্থী না থাকার নেপথ্যে সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক। তিনি বলেন, ‘ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আট দলীয় জোটে নারী প্রার্থী না থাকার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে: প্রথমত—ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের সরাসরি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কম অংশগ্রহণের প্রবণতা রাখে। দ্বিতীয়ত—ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রভাব রয়েছে, যেখানে কিছু ইসলামী দল নারীদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভূমিকাকে সীমিত দৃষ্টিতে দেখে। তৃতীয়ত—জোটের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে তারা নারী আসনে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বকে প্রাধান্য দিতে পারে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের প্রতিনিধিত্বের বৃহত্তর আলোচনায় প্রশ্ন উত্থাপন করে, যেখানে সংসদে নারী আসন সংরক্ষণ করা হলেও সরাসরি নির্বাচিত নারী প্রার্থীর সংখ্যা এখনো সীমিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এ অবস্থাকে বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির রক্ষণশীল চরিত্রের প্রকাশ হিসেবে দেখা যায়।’