Image description
 

বহুল প্রতীক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শঙ্কা কাটিয়ে দেশ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেল। তপশিলের পর এখন রাজনৈতিক দলগুলোর পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ হবে নির্বাচনের দিকে। নির্বাচন ঘিরেই তাদের সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আগে থেকেই শুরু হওয়া বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ দলগুলোর প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম এখন আরও গতি পাবে। এ ছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী জোট গঠনসহ মিত্রদের আসন বণ্টন বা সমঝোতার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করবে দলগুলো। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখন ভোটের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। দলগুলোসহ দেশের মানুষ এখন অপেক্ষা ভোটের দিনের। দেশবাসীর প্রত্যাশা, উৎসবের আমেজে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে সুষ্ঠু ভোট হয়নি। মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। যে কারণে ভোটের জন্য মানুষ এখন মুখিয়ে আছে। তপশিলের পর এখন জনগণ ভোটের দিনের অপেক্ষায়। তবে অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও জানান নেতারা। তারা বলেন, ভোটের সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সব দলকে ভোটের মাঠে সমান সুযোগ দিতে হবে।

তারা আরও বলেন, আগামী নির্বাচনে একটি পক্ষ থাকছে না। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে একটি পক্ষ অংশ নেয়নি, এবার আরেকটি পক্ষ নেই।

 

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের যারা পক্ষভুক্ত দল, তারা আছে। সুতরাং দলগুলোর নিজেদের মধ্যে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যেন আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ-বিতর্কিত হয়। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে পার্লামেন্ট বিতর্কের মধ্যে পড়বে। ফলে পরবর্তী সরকারকেও একটা বিতর্কের মধ্যে যাত্রা করতে হবে। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সব পক্ষকে অত্যন্ত যত্ন, মনোযোগ ও সতর্কতার সঙ্গে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে।

 
 

নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বেশ আগে থেকেই মাঠে রয়েছে। দলীয় প্রার্থিতা ঘোষণার পর গণসংযোগের পাশাপাশি নির্বাচনী জোট বা আসন সমঝোতা নিয়েও দলগুলো কাজ করছে। এরই মধ্যে তিনটি নির্বাচনী জোট গঠিত হয়েছে। ৯টি বাম দল নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’। জাতীয় পার্টির (জাপা) একাংশ ও জাতীয় পার্টি-জেপির নেতৃত্বে এসেছে নতুন জোট ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’। জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন অংশ দুটিসহ মোট ১৮টি দল থাকছে এই জোটে। তবে আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গঠিত নতুন ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বেও জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা ছাড়াও জামায়াতের বাইরে দু-একটি ইসলামী দল এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ৮টি ইসলামী দলের জোটও আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। ‘ওয়ানবক্স পলিসি’ অর্থাৎ একটি বাক্সে ইসলামী দলগুলোর সব ভোট যাতে পড়ে, সেই পলিসি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তারা।

 

পুনর্গঠন হচ্ছে ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’: নির্বাচন সামনে রেখে পুনর্গঠন হচ্ছে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট’। পুনর্গঠন উপলক্ষে গতকাল জোটের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতির বক্তব্যে সাবেক সংসদ সদস্য এমএ আউয়াল বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে তিনটি নিবন্ধিত দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোটের (বৃহত্তর সুন্নি জোট) সঙ্গে এই বৃহৎ জোট গঠনের আলোচনা চলছে। বৃহৎ জোটের নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে ভোট করবেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট অফিসারসহ যারা দায়িত্বে থাকবেন, তাদের প্রত্যেকের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিকদের মনে এখনো যে শঙ্কা ও ভীতি রয়েছে, তা দূর করা না গেলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তপশিলের পর এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী কার্যক্রমে গতি সঞ্চার হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘তপশিলের পর প্রাথমিক শঙ্কা কেটেছে, পুরোপুরি শঙ্কা কাটবে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন একটা আশা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচনটা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা এর আগে আমাদের কথা ও আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তিনি নির্বাচন করবেন। তপশিলের মধ্য দিয়ে সেটার বাস্তবায়ন শুরু হলো। এতে করে আমাদের আস্থা ও প্রত্যাশাটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে, উনি যে কথা দিয়েছিলেন—সেটা রেখেছেন। এখন আমাদের নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নির্বাচনটা কীভাবে হয় কিংবা নির্বাচন হয় কি না।

নির্বাচন কমিশনের তপশিল ঘোষণা বিএনপিকে আশ্বস্ত করেছে জানিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চায়। জনগণের ভোটের অধিকার বাস্তবায়িত করতে চায়। মূল বিষয়টা হচ্ছে—২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা হয়েছে, একই সঙ্গে গণভোট। আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এখানে সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী সচেতনভাবে এই নির্বাচনটিকে একটি উৎসবমুখর নির্বাচনে পরিণত করবেন।

নির্বাচনী সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, তাদের অবশ্যই যথাযথভাবে বিবেচনা করব, আমরা মূল্যায়ন করব।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, নির্বাচনের জন্য আমরা এক বছর থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ৩০০ আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাই করে মাঠে কাজ করার জন্য বলেছি। এর মধ্যে আবার আন্দোলনরত আমরা ৮টা দল আছি, যারা প্রার্থী বাছাইয়ের দিকে যাচ্ছি। শীর্ষ নেতারা বসে প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। সব মিলিয়ে আমরা প্রস্তুত।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে যাচ্ছে। নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি। আমরা একটি কথা বলব, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন নিয়ে সদিচ্ছা রয়েছে, কিন্তু নিরপেক্ষতা এবং সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই সরকার নির্বাচন করবে কি না—এ নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, সেই সন্দেহ এবার দূর হলো। ভোটের মতোই গণভোট নিয়ে যে সন্দিহান আবহ, সেটিও কাটিয়ে উঠবে সরকার।

গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নির্বাচন যাতে অবাধ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, তার জন্য একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা—এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থার মধ্যে নিয়ে একটা ভালো নির্বাচন করতে হবে।

নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের এই সমন্বয়ক বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্দিন-কঠিন দিনগুলোতে যারা রাজপথে লড়াইয়ের শরিক ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রধান শরিক বিএনপিকে যথাযথ বিবেচনা করতে হবে। এটা বিএনপির কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার না, এটা ন্যায্যতা-মর্যাদা-প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন। লড়াইয়ের এই মানুষগুলো যাতে পার্লামেন্টেও আসতে পারে, পার্লামেন্টে যেন লড়াইয়ের একটা প্রতিনিধিত্ব থাকে—এটাই বিবেচনার প্রশ্ন। বিএনপি নির্বান্ধব হওয়ার যে কৌশল নিয়েছে, আশা করি, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেখান থেকে সরে আসবে এবং সবাইকে আস্থার মধ্যে নিয়ে তাদের মিত্র-বন্ধুর সংখ্যা বাড়াবে। কেননা, সামনে অনেক বড় বড় ঝুঁকি আছে, সেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধতা লাগবে।