নির্বাচন নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। গণভোট ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে ১২ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট হবে সাদা-কালো। আর গণভোটের ব্যালটের রং হবে গোলাপি। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ দুটি নির্বাচনের তফসিল আজ সন্ধ্যা ৬টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। বুধবার বিকালে সিইসির ভাষণ রেকর্ড করেছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার।
এদিকে এর আগের আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে বুধবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন তারা। সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচন আয়োজনে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ইসির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তফসিল ঘোষণার আগের দিন আপিল বিভাগের দেওয়া রায় মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। কমিশনের এক অনানুষ্ঠানিক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে গাজীপুরে একটি আসন কমে যাবে। আর বাগেরহাটে কেটে নেওয়া আসন ফেরত দেওয়া হবে। আজ তফসিল ঘোষণার আগে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে। একই সঙ্গে নতুন সীমানা অনুযায়ী ভোটার তালিকা তৈরিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিতে ইসি সচিবালয়কে বলা হয়েছে। তবে বুধবার রাত পর্যন্ত নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার সংশোধনী গেজেট জারি হয়নি। ওই গেজেট জারি হওয়ার আগেই বিজি প্রেসে মনোনয়নপত্র ছাপার কাজ শুরু করেছে ইসি।
তফসিল ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, সিইসির ভাষণ রেকর্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবার (আজ) সন্ধ্যা ৬টায় ওই ভাষণ সম্প্রচার করা হবে। এর মধ্য দিয়েই বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধিসহ অন্যান্য আইন ও বিধিমালা প্রয়োগ শুরু করবে ইসি। দেশের মানুষ ভালো পরিবেশ দেখতে পাবে বলে আশা করছি। সীমানা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, আপিল বিভাগের রায় হয়েছে। আমরা ওই রায়কে শ্রদ্ধা জানাই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা ছিল। তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সবকিছুর অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ঢুকতে যাচ্ছে দেশ। এ নির্বাচনে প্রবাসীরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। বুধবার রাত ৮টা পর্যন্ত দুই লাখ ৯৭ হাজারের বেশি প্রবাসী অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এ সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ২০২৫ সালের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। পরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। ওই ঘোষণার সময়সীমার মধ্যে এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই প্রথম নির্বাচন। নির্বাচন পরিচালনায় ‘অনভিজ্ঞ’ এই অন্তর্বর্তী সরকার ও ইসির অধীনে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হতে যাচ্ছে।
ইসি সূত্রে আরও জানা গেছে, এবারই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ‘প্রতীকী’ রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বাকি সব আসনে আগের মতোই জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে যাচ্ছে কমিশন। আজ তফসিল ঘোষণার পরই রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়ার কথা রয়েছে। এদিনই কয়েকটি পরিপত্র জারি করবে কমিশন। ওইসব পরিপত্রে নির্বাচনি আগাম প্রচার সামগ্রী অপসারণ, নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ থাকবে। পাশাপাশি সরকারকে বেশ কয়েকটি চিঠি দেওয়া হবে। এসব চিঠিতে নির্বাচনি কাজে সহযোগিতা করতে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া, ত্রাণসহ অন্যান্য অনুদান বিতরণ বন্ধ রাখা, নতুন প্রকল্প অনুমোদন না করাসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে।
সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করবেন রাষ্ট্রপতি : তফসিল ঘোষণার আগের আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে বুধবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার। ওই সাক্ষাতের বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেসব বিষয় জানিয়েছেন তার ভেতরে একটা হচ্ছে ভোটার তালিকা। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, গত জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন যেটা হয়েছে সেটার সর্বশেষ অবস্থাও জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুটো ভোট একই দিনে হওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট কীভাবে আমরা করব, ব্যালট পেপারগুলো কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে, ব্যালট পেপারগুলোর রং কী হবে ও ব্যালট পেপার কীভাবে একজন ভোটারকে দেওয়া হবে এসব বিষয় রাষ্ট্রপতি জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে আমাদের মক ভোটিংয়ে কতটুকু সময় নিয়েছি এবং গণনার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা তাকে বিস্তারিত জানানোর পর তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে আমাদের ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর বিষয়েও তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পোস্টাল ভোটিং বিষয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, আউট অব কান্ট্রি ভোটিং এন্ড ইন কান্ট্রি পোস্টাল ভোট সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানিয়েছি। এটা শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং তিনি সার্বিকভাবে আমাদের বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাচ্ছে। একটা ভালো, সুষ্ঠু এবং অর্থবহ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা এবং সহানুভূতি তার দিক থেকে প্রয়োজন তিনি তার থেকে বেশি ছাড়া কম দেবেন না।
সংসদীয় আসনে পরিবর্তন : তফসিল ঘোষণার আগে সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ইসি। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী এ পরিবর্তন আসছে। সীমানা নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, রিট আবেদনে সংযুক্ত গত ৪ সেপ্টেম্বরের গেজেট নোটিফিকেশনের (ইসির প্রজ্ঞাপন) সংসদীয় আসন নম্বর ৯৫ (বাগেরহাট-১), আসন নম্বর ৯৬ (বাগেরহাট-২), আসন নম্বর ৯৭ (বাগেরহাট-৩) ও আসন নম্বর ১৯৮ (গাজীপুর-৬) গঠন-সম্পর্কিত অংশটুকু অবৈধ, আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। এ বিষয়ে এর আগে হাইকোর্টের রায়ে বাগেরহাটে চারটি সংসদীয় আসন পুনর্বহাল করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই রায়ে বলা হয়, সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে ২০২৩ সালের ১ জুলাই উল্লেখিত গেজেট অনুসারে আগের মতো সংসদীয় আসন নম্বর ৯৫ (বাগেরহাট-১), আসন নম্বর ৯৬ (বাগেরহাট-২), আসন নম্বর ৯৭ (বাগেরহাট-৩) এবং আসন নম্বর ৯৮ (বাগেরহাট-৪) পুনর্বহাল করে গেজেট প্রকাশ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে বুধবার ইসির সচিব বলেন, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ৩০০ আসনের তফসিল করা হবে। আদালতের রায়ের আদেশ পাওয়া গেলে যদি সংশোধন লাগে সেটাও সেভাবে করা যাবে।