রমজান এলেই বেপরোয়া হয়ে উঠে মজুতদাররা। ডান-বাম না তাকিয়ে কৌশলে পণ্যের মজুত গড়ে তোলেন তারা। অনৈতিক মুনাফা লোটার এই সুযোগ হাতছাড়া করেন না। প্রতিবছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যবসায়ীরা দাম না বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও এর প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায় না। বরং উলটো বৃদ্ধি পায়। এজন্য সবাই সিন্ডিকেটকে দায়ী করলেও বরাবরই জড়িতরা থাকেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ২ মাসের বেশি বাকি থাকতেই বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির খবর পাওয়া গেলেও বাড়তে শুরু করেছে রমজানের পণ্য-ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি, মুড়ি, সয়াবিন, মসুর ডাল, মুরগি ও মাংসের দাম।
সরকারের নির্দেশনায় রমজাননির্ভর পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে পাইপলাইনে আছে আরও বিপুল পরিমাণ পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রোজা ঘিরে এবার এলসি খোলার হার ১১-২৯৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এবার কর্তৃপক্ষ বলছে, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন, গত ২ মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি ছোলার দাম বেড়েছে ১০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ৮ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডাল কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। ২ মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতার ৭০ টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। কেজিতে জিরার দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকার বেশি। কেজিতে ৫০ টাকা বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। ডিমের দাম ডজনে ১০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে চিনির দাম ২ মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা কমেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, অসাধুদের এই কারসাজির কৌশল ওপেন সিক্রেট হলেও সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকায়। নেওয়া হয় লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ। কোনো বছরই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছেন তাদের অপকর্ম। তাদের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তা। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। মনিটরিংও আগেভাগেই করতে হবে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোজায় পণ্যের চাহিদা ও মজুত পরিস্থিতি : প্রতিবছর দেশে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা এক লাখ ৩৬ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয় ৮২ হাজার টন। বর্তমানে দেশে ১৭ লাখ টনের উপরে আমদানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন। পুরো বছরের চাহিদার তুলনায় দেশে ১৮ হাজার টন চিনি বেশি আছে। বছরে ছোলার চাহিদা দুই লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৮০ হাজার টন।
স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার টন। এ পর্যন্ত চার লাখ টন আমদানি করা হয়েছে। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি রয়েছে। একই ভাবে বছরে মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। এক মাসের চাহিদা ৩৮ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে চাহিদা ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয় দুই লাখ ৬৬ হাজার টন। এখন পর্যন্ত আমদানি হয়েছে প্রায় এক লাখ টন। এছাড়া আরও ডাল আমদানি পর্যায়ে রয়েছে । এছাড়া দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৬-২৮ লাখ টন। এর মধ্যে রোজার মাসে চাহিদা তিন লাখ টন। গত অর্থবছরে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। সংরক্ষণ সমস্যাসহ নানা কারণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গত অর্থবছরে ৩৩ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ বাজারে এসেছে। গত অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৮৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ টন। ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় দেশে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি আছে।
রমজাননির্ভর পণ্যের ঋণপত্র খোলার চিত্র : রমজান মাসে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য হিসাবে পরিচিত ছোলা, খেজুর, মটর ডাল, চিনিসহ ছয় ধরনের পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বেড়েছে। রোজায় এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে তাই আগেভাগেই পণ্যগুলো আমদানির ঋণপত্র খোলা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোনো কোনো পণ্যের ঋণপত্র খোলার হার ১১-২৯৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ঋণপত্র খোলার পর পণ্য আসতে ৩ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির আগেই এসব পণ্য দেশে চলে আসার কথা। পাশাপাশি চলতি মাসে পণ্য আমদানি করতে আরও বেশি ঋণপত্র খোলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে-২০২৪ সালে ছোলা আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৪২ হাজার ৮৯১ টন। চলতি বছরে এলসি খোলা হয়েছে ৮৪ হাজার ৫১৬ টন। এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ। পাশাপাশি গত বছর সয়াবিন তেল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪ টন। চলতি বছরে এলসি খোলা হয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬৫ টন। পরিমাণ বেড়েছে ৩ শতাংশ। ডাল আমদানিতে গত বছর এলসি খোলা হয়েছে ২৬ হাজার ৯১২ টন, যা চলতি বছরে খোলা হয়েছে ৫০ হাজার ৩৫৫ টন। পরিমাণ বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। গত বছর চিনি আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪৬ টন। যা চলতি বছরে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৭২ টন এলসি খোলা হয়েছে। পরিমাণে বেড়েছে ১১ শতাংশ। মটর ডাল আমদানিতে ২০২৪ সালে আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৪১ হাজার ৮১৫ টন। চলতি বছরে ২৯৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১০ টন মটর ডাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে।
এদিকে ২৯ নভেম্বর এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, রমজান মাসে পণ্য আমদানি নিয়ে ও মূল্য পরিশোধে কোনো শঙ্কা নেই। গত বছর রমজানে পর্যাপ্ত ফরেন এক্সচেঞ্জ দিয়ে সরবরাহ ঠিক করতে পেরেছিলাম। এই বছরের রমজান ঘিরে আমি এখনই বলতে পারি, আমরা কোনো ধরনের শঙ্কা দেখছি না। রমজানের যেসব পণ্য আমদানি হয়, সেটা ইতোমধ্যে এলসি ওপেনিং হয়ে গেছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার চিত্র: রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রোববার প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা। যা দুই মাস আগেও ১১০ টাকা ছিল। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯৮ টাকা। যা আগে ১৯০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি সরু মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। যা আগে ১৫০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা, যা দুই মাস আগেও ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। যা আগে ১৭০ টাকা ছিল। এছাড়া কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বেড়ে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। পাশাপাশি প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। যা আগে ১২৫-১২৬ টাকা ছিল। তবে কমেছে চিনির দাম। কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। রমজানকে টার্গেট করে বিশেষভাবে তদারকি করা হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।