চট্টগ্রামে গত ১৬ বছরে একাধিক বহুতল ভবনসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এক ড্রাইভার (গাড়িচালক)। অথচ তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করেন সেই কোম্পানি ঋণভারে জর্জরিত। ‘সৌভাগ্যবান’ এই ড্রাইভারের নাম হাসমত আলী। তিনি কর্ণফুলী উপজেলার খোয়াজনগর ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তবে এখন তিনি নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াতে যোগ দিয়েছেন। তার বাবার নাম মনু মিয়া।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সরকারি জমি দখল করে মার্কেট ও দোকানপাট গড়ে ভাড়া দেওয়া, পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও দখল-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েন। সরকার পতনের পর ৩ মাস আগের একটি তারিখে জামায়াতের ‘সহযোগী সদস্য’ ফরম পূরণ করে রাতারাতি ভোল পালটে ফেলেন। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও তিনি এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছেন। প্রশাসন তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারছে না।
জানা গেছে, খোয়াজনগর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটিতেও সভাপতি হিসাবে ছিলেন হাসমত আলী। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সোলাইমান তালুকদারের স্বাক্ষরে এই কমিটি দেওয়া হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার পেশা ড্রাইভার। তিনি খোয়াজনগরের ‘গোল্ডেন সন লিমিটেড’ নামে একটি পুতুল ও ফ্যান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ড্রাইভার হিসাবে চাকরি করেন। তবে তিনি ড্রাইভার হলেও মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে সখ্য রেখে চলতেন। দলীয় পদের সুবাদে শিল্প অধ্যুষিত চরপাথরঘাটা ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এলাকায় সাইফুজ্জামান চৌধুরীর (সাবেক ভূমিমন্ত্রী) নির্বাচনি প্রচারণা ও সভা-সমাবেশে তাকে দেখা গেছে মুখ্য ভূমিকায়। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের শন্যারটেক থেকে ব্রিজঘাট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুই একর জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন অর্ধশতাধিক দোকানপাট, ট্রাকস্ট্যান্ড ও মার্কেট। রীতিমতো তার নিজের নামেই এখানে গড়ে উঠেছে ‘হাসমত আলী মার্কেট’। গত ১৬ বছর ধরে সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা মার্কেট-দোকানপাট ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা আয় করেন। একেকটি দোকান ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম নিয়ে মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দেন। এই সময়ে খোয়াজনগর ও আজিমপাড়া এলাকায় অন্তত ৫টি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। আরও একাধিক ভবন রয়েছে নির্মাণাধীন। এসব ভবনের কোনোটি নিজের কোনোটি তার ভাই মাহবুব আলীসহ যৌথ মালিকানায়। মাহবুব আলীও একই কোম্পানিতে ফর্কলিফট চালক হিসাবে কর্মরত। এছাড়া তার স্ত্রী, ভাইসহ স্বজনদের নামে-বেনামে বিপুল মূল্যবান জমি কিনেছেন শিল্প এলাকায়। তাদের বেশ কিছু জমির দলিল প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
গোল্ডেন সন লিমিটেড নামে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ। হাজার কোটি টাকা ঋণের ভারে জর্জরিত এই প্রতিষ্ঠান। ঋণ রিশিডিউল করার জন্য কোম্পানি এই ব্যাংক থেকে ওই ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছে। অথচ কোম্পানিরই একজন সামান্য ড্রাইভার বনে গেছেন বিপুল সম্পদের মালিক। কীভাবে একজন ড্রাইভার হয়ে এত সম্পদ অর্জন করলেন সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। এ বিষয়ে জানার জন্য গোল্ডেন সনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত এবং থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন আছেন উল্লেখ করে বলেন, ড্রাইভারের বিষয়ে আবার কিসের ইনভেস্টিগেশন।
সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা ‘হাসমত আলী মার্কেটে’ নুরুন্নবী টেলিকম নামে একটি ফোন-ফ্যাক্স ও বিকাশের দোকান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নুরুন্নবী যুগান্তরকে জানান, তিনি দোকানটি ৪-৫ বছর আগে ৪০ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে নিয়েছেন। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া দেন। হাসমত আলীর ভাই শরাফত আলী ভাড়া তোলেন। তার দোকানটিসহ মার্কেটে ২০-২৫টি দোকান আছে। এসব দোকান সিডিএর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে।
স্থানীয় বিএনপি নেতা ও বিএনপি সমর্থিত সাবেক ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভোটকেন্দ্র দখলের নেতৃত্ব দিতেন এই হাসমত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে যত সংখ্যক ভোট আছে ব্যালট পেপার ছিঁড়ে সব ভোট তার নেতৃত্বেই বাক্সে ভরার নজির আছে।
৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি, চান্দগাঁও ও রাঙ্গুনিয়া থানাসহ বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় করা একটি মামলায় ১০ নম্বর, রাঙ্গুনিয়া থানার মামলায় ৩৪ নম্বর আসামি। সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর একটি কোম্পানির ঝুটের গাড়ি ছিনতাই ও হামলার অভিযোগে কর্ণফুলী থানায় একটি মামলা করা হয়। এই মামলায় হাসমত আলী প্রধান আসামি। এর বাদী বজলুল করিম নামে এক ব্যক্তি। কর্ণফুলী থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম (সদ্য বদলি হওয়া) তার থানায় হাসমত আলীসহ একাধিক আসামির বিরুদ্ধে একটি মামলা হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, ওই এলাকার এমপি-মন্ত্রী, উপজেলা-জেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতা পালিয়ে গেলেও নানা অপকর্মে অভিযুক্ত হাসমত আছেন বহাল তবিয়তে। জামায়াতের ‘সহযোগী সদস্য’ হিসাবে যোগ দিয়ে এলাকায় নতুন করে ‘রাজত্ব’ শুরু করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা জামায়াতের আমির মোহাম্মদ মুসা যুগান্তরকে বলেন, হাসমত আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি জামায়াতের ‘সহযোগী সদস্য’ ফরম পূরণ করেছেন বলে জানতে পেরেছি। তবে এই ফরম পূরণ করলেই যে জামায়াত হয়ে যাবেন এমনটা নয়। সদস্যপদ পূরণ করার পর অনেকেই তার বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। তাই তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। কৌশল হিসাবে হাসমত আগের তারিখে (৫ মে, ২৪) ফরম পূরণ করেছেন বলে মনে হচ্ছে। তবে হাসমত এলাকায় দানবীর হিসাবে পরিচিত বলে জানি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ও খোয়াজনগর এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ নুরুল আবছার যুগান্তরকে বলেন, হাসমত আলী খোয়াজনগর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের দমনে মইজ্জারটেকে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করেন তিনি। আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী। প্রশাসনকে প্রভাবিত করে আমার বিরুদ্ধেও ৮টি মামলা দিয়েছেন এই হাসমত। চতুর এই ব্যক্তি এখন জামায়াতের সহযোগী সদস্য সাজার চেষ্টা করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসমত আলী যুগান্তরকে বলেন, আমি কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি। এডিট করে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। আমি ১৯৯৬ সাল থেকে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। বিগত সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের (জামায়াত) টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। যারা আমাকে বৈষম্যবিরোধী মামলায় নাম দিয়েছে তারা না জেনেই দিয়েছে। ১০ বছর আগে ড্রাইভারের চাকরি করলেও বর্তমানে আমি কোম্পানির এস্টেট দেখাশোনার দায়িত্বে আছি। সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট ও দোকানপাট গড়ে তুলে ভাড়া দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্য লোকের কাছ থেকে দখল কিনে নিয়ে মার্কেট ও দোকানপাট করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় সিডিএ এসে ভেঙে দেয়। আমার মালিকানাধীন কোনো বহুতল ভবন নেই। যা কিছু অর্জন সব বৈধ উপায়েই।