জুলাই আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর মিরপুর ইসিবি চত্বরে হামলায় গুরুতর আহত দাবি করে ঢাকার আদালতে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন মো. আব্দুল আজিজ। মামলায় আড়াই শ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তবে তদন্তে নেমে মামলার বাদীর অস্তিত্ব এবং সাক্ষীদের খুঁজে পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই কখনো ঢাকায়ই আসেননি। শুধু কথিত বাদী আব্দুল আজিজই নন, আদালতে দায়ের করা সিআর (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার) মামলার অনেক বাদী ও সাক্ষীই ভুয়া।
তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত সংস্থা। ফলে তদন্ত শেষে ওইসব মামলায় ‘অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ফাইনাল রিপোর্ট’ দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পিবিআই-এর তদন্ত করা মামলাগুলোর মধ্যে ৫৬ ভাগের ভাগ্যে এমনটি ঘটেছে। এসব মামলার মধ্যে কিছু কিছুর বাদী নিজেও তার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এছাড়া তদন্ত শেষ হওয়ার পর পিবিআই যে ৪৪ ভাগ মামলার চার্জশিট দিয়েছে, সেসবের বেশির ভাগ আসামিও ভুয়া। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জুলাইয়ের রক্তাক্ত দিনগুলোর ঘটনা নিয়ে মামলার তদন্তের এই হাল কেন-এমন প্রশ্নে পিবিআই-এর প্রধান (অতিরিক্ত আইজি) মো. মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলাগুলোয় শতশত লোককে আসামি করা হয়েছে। ঘটনা ঢাকার, অথচ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলার লোকজনকে ঢাকার মামলায় আসামি করা হয়েছে। যারা কখনো ঢাকার মুখও দেখেননি। তিনি বলেন, কে কোন রাজনৈতিক দলের, সেটা মামলার তদন্তের বিষয় নয়। যদি সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে কেন কাউকে আসামি করা হবে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে যাতে সাধারণ ও নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হন। কিছু মামলা প্রত্যাহার হয়েছে। কিছু মিথ্যা মামলাও আছে। তদন্তে যা পাওয়া যাবে, সেটাই দেব-মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নিরপরাধ মানুষকে মামলায় ঢুকিয়ে হয়রানি করা হলে, এর জন্য আইনি সুরক্ষা আছে বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, যারা মিথ্যা মামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
পিবিআই সূত্র বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা ১৯২টি সিআর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর মধ্যে হত্যা মামলা ২৯টি। হত্যাচেষ্টাসহ অন্যান্য ধারায় রয়েছে ১৬৩টি। আদালতের মাধ্যমে দায়ের করা এসব মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৭৮টি নিষ্পত্তি করেছে সংস্থাটি। নিষ্পত্তিকৃত এসব মামলার মধ্যে ৯টি হত্যা এবং ৬৯টি অন্যান্য ধারার মামলা। এর মধ্যে প্রমাণিত ৩৪টি, অপ্রমাণিত ও আপস বা প্রত্যাহার করা মামলা ৪৪টি। প্রমাণ হওয়া মামলার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসামি ভুয়া। কোনো কোনো মামলার আসামিদের ৯০ ভাগই ভুয়া থাকার তথ্য মিলেছে।
এদিকে নিষ্পত্তি হওয়া ৭৮টি মামলার ২৭টি প্রমাণিত হয়নি। অন্যান্য ১৭টি মামলা বাতিল, রিকলমূলে নিষ্পত্তি, বাদী কতৃক ২৪৮ ধারায় প্রত্যাহার। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে আইনজ্ঞরা বলছেন, পিবিআই-এর তদন্তে ৫৬ ভাগ মামলা ভুয়া বলা হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পিবিআই-এর বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে ৫৬ ভাগ মামলা প্রমাণ হয়নি। এ কথাটি বহু আগে থেকে আমরা বলে আসছি। কাজেই পিবিআই নতুন করে কিছু পায়নি বরং আরও পাওয়া দরকার ছিল। সরকার, মিডিয়া এবং আমরা সবাই বলে আসছি-এ মামলাগুলো মিথ্যা, মানে যথাযথ না। সেই মিথ্যা মামলা পিবিআই-এর একটি ফরমালি তদন্তের মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমাদের সেই কথাই প্রমাণ হয়েছে। তিনি বলেন, ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মামলা প্রমাণ হবে না, এটা আমরা বলেছি। এ মামলাগুলো চাঁদাবাজির জন্য হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চরম নৃশংসতা চালায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা নির্বিচারে হত্যা করে ছাত্র-জনতাকে। তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ভুক্তভোগীরা মামলা দেওয়া শুরু করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে নিরপরাধ মানুষকে আসামির তালিকায় ঢোকানো এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর নাম ঢুকিয়ে চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে জুলাই আন্দোলনের মামলায় আসামি গ্রেফতারে ‘ঊর্ধ্বতনের অনুমতি’ লাগবে মর্মে নির্দেশ দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এছাড়া ভুয়া আসামিদের নাম বাদ দিতে উদ্যোগ নেয় সরকার।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় সারা দেশে থানা ও আদালতে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৮৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১০৬টির। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩-এর (অ) ধারায় ৪৩৭টি মামলায় ২ হাজার ৮৩০ জনকে এ পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আদালতে অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
পিবিআই-এর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া মামলার বেশির ভাগই বাদী ও সাক্ষীর কোনো অস্তিত্ব নেই।
বাদী মো. আব্দুল আজিজের করা সিআর মামলা নম্বর ৮৯০/২০২৪ (মিরপুর)। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর ইসিবি চত্বরে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় গুরুতর আহত হন বলে দাবি করেন বাদী। ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০-২৫০ জনকে আসামি করেন তিনি। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। এসআই হুমায়ন কবির তদন্ত শেষে ঢাকার আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট (প্রমাণ হয়নি) জমা দেন। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বাদী আব্দুল আজিজের স্থায়ী ও অস্থায়ী নাম-ঠিকানা ভুয়া। জাতীয় পরিচয়পত্রও জাল। মামলায় যে মোবাইল নম্বরটি উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিও অন্য এক নারী ব্যবহার করেন। আব্দুল আজিজ নামের কাউকেই চেনেন না ওই নারী। সাক্ষী হিসাবে যাদের নাম রয়েছে, তাদেরও নাম-ঠিকানা ভুয়া।
কথিত বাদী আজিজের মামলার ১১ নম্বর আসামি আব্দুল লতিফের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার বেতকান্দি গ্রামে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কৃষিকাজ করি। গত ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় যাইনি। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা শত্রুতা করে মামলায় আমার নাম ঢুকিয়েছে। এখন পর্যন্ত দুটি মামলায় নাম দিয়েছে আমার। গ্রেফতার করানোরও চেষ্টা করেছে।’
এমন আরেকটি মামলার বাদী মো. রাজিন ওরফে রাজন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিতে আহত হয়েছেন দাবি করে ২ জানুয়ারি আদালতের মাধ্যমে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মামলার বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেন, গত বছরের ১৮ জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বনানী চেয়ারম্যানবাড়ীর সামনে আসামিদের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। পরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। মামলায় ১২৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২৫ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
মামলা তদন্ত শেষে পিবিআই-এর পরিদর্শক মো. আজিজুল হক আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, এ মামলার বাদীর সব তথ্য ভুয়া। এমনকি মামলায় যে মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি ব্যবহার করেন অপর এক ব্যক্তি। এছাড়া সাক্ষীদেরও কোনো অস্তিত্ব নেই।
সূত্র বলছে, ডিএমপির তেজগাঁও থানার একটি হত্যা মামলার (৯৬০/২০২৪ নম্বর মামলা) তদন্ত করেন এসআই ফিরোজ আহম্মেদ মুন্সী। মামলাটিতে ২০৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৯০০ জনকে আসামি করা হয়। এসআই ফিরোজ যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি করেন এক উৎসুক জনতা। নিহতের বাবা একই ঘটনায় অন্য একটি থানায় মামলা করায় আদালত সিআর মামলাটি খরিজ করে দিয়েছে।
প্রমাণিত হওয়া মামলায় পিবিআই-এর তদন্তে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলনের সময়ের ৩৪টি মামলার মধ্যে বেশির ভাগ আসামির সঙ্গে ঘটনার কোনো সম্পৃক্ততা মেলেনি। ওইসব আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে অন্যতম সিআর মামলা নম্বর ৪৪৪৮/২০২৪ (গুলশান)-এর ৭৭.৪২ ভাগ, ০৩/২০২৫ (তুরাগ)-এর ৯০.৪০ ভাগ, ৫৪১/২০২৪ (বাড্ডা)-এর ৫৫.৭০ ভাগ, ৭৭০/২০২৪ (যাত্রাবাড়ী)-এর ৪৮ ভাগ, ৯০২/২০২৪ (যাত্রবাড়ী)-এর ৮৪ ভাগ, ৭৬৭/২০২৪ (যাত্রাবাড়ী)-এর ৬৭ ভাগ, ৯৯৫/২০২৪ (বাড্ডা)-এর ৮৫.২৩ ভাগ, ১৭০৮/২০২৪ (বোয়ালিয়া)-এর ৮১.৮১ ভাগ, ৩৮৪/২০২৪ (রাজপাড়া)-এর ৬৬.৩৩ ভাগ এবং ২৪৭/২০২৪ (জালালাবাদ)-এর ৮২.০৫ ভাগ আসামি ভুয়া।
গত বছর ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বুকের পাশে গুলিবিদ্ধ হন সজীব (১৯) নামের এক যুবক। এ ঘটনায় তার বাবা মহসীন বাদী হয়ে ২৫৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন (মামলা নম্বর ৯০২/২০২৪-যাত্রাবাড়ী)। মামলাটি তদন্ত করেন পিবিআই-এর এসআই মো. জামিল উদ্দিন রাশেদ। তদন্ত শেষে মাত্র ২০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। মামলা থেকে ২৩৩ জনের নাম বাদ দেন তিনি। অর্থাৎ, ৮৪ ভাগ আসামি ভুয়া। এ বিষয়ে এসআই মো. জামিল উদ্দিন রাশেদ যুগান্তরকে বলেন, ২৫৩ আসামির মধ্যে মাত্র একজন যাত্রাবাড়ীর। ১৫ থেকে ১৬ জন ঢাকার। অন্য সবাই দেশের বিভিন্ন জেলার। তাদের মোবাইল সিডিআর পর্যালোচনা করে ঢাকায় তাদের লোকেশন বা অবস্থান পাওয়া যায়নি।