বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে লাশ উত্তোলন শুরু করেছে সিআইডি। আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লক থেকে জুলাই শহীদদের এই লাশ উত্তোলন কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় অনেকেই আসেন তাদের নিখোঁজ স্বজনের লাশের খোঁজে। তাদের মধ্যে কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ স্বামী, কেউ বা হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি। স্বজন হারানোর এসব মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে কবরস্থান প্রাঙ্গণ।
নার্জিয়া ইসলাম নূপুর এসেছিলেন স্বামী মো. রফিকুল ইসলামের লাশের খোঁজে। কালো বোরকা পরিহিত মধ্যবয়সী ওই নারী সিআইডি ক্রাইমসিন সদস্যদের হলুদ বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা রাস্তার একপাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। আমার স্বামী ঢাকায় কম্পিউটারের ব্যবসা করতো। আমরা ঢাকার গোপীবাগে ভাড়া বাসায় থাকি। আমাদের একটাই সন্তান রায়হান ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। গত বছর যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন ১৯শে জুলাই আমার স্বামী নামাজ পড়তে স্থানীয় একটি মসজিদে যায়। এরপর থেকে আর ফিরে আসেনি। মসজিদের আশপাশের লোক আমাদেরকে বলে- তোমার স্বামী মসজিদ থেকে বের হয়ে দোকানে ডিম কিনছিল। ডিমসহ-ই তাকে একদল মানুষ গলির ভেতর কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের সঙ্গে পুলিশ ছিল। পরে পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেছে। ওই কথা শোনার পর আমি থানা, কারাগার, আদালত, হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় তন্ন তন্ন করে আমার স্বামীকে খুঁজেছি। কিন্তু কোনোভাবেই তার হদিস পাইনি। তখন ঢাকা মেডিকেলে একের পর এক লাশ এসেছে, সবগুলো আমি খুঁজে দেখেছি, অনেক সময় লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, তাও পাইনি। পরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে জানতে পারি- আন্দোলনে নিহত অনেকের লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে আঞ্জুমানের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে। এরপর গত বছরের ৯ই আগস্ট আমি সেখানে যাই।
শত শত লাশের ছবির মধ্যে আমি দেখতে পাই আমার রায়হানের আব্বুর ছিন্ন-ভিন্ন শরীরের ছবি। সেখান থেকে আমাকে বলা হয়, আপনার স্বামীর লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। পরে সেখান থেকে এখানে (রায়ের বাজার কবরস্থান) আসি। এসে দেখি আমার স্বামীর মতো আরও অনেকের লাশ কাতারে কাতারে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা হয়েছে। কোনোটারই কোনো নাম-চিহ্ন নেই। খোদ গোরখোদকরাও বলতে পারেনি- কোনটা কার কবর, কোথায় কাকে দাফন করা হয়েছে! এরপরও স্বামীর লাশটা এখানেই কোথাও আছে এই ভেবে গত এক বছর প্রায় প্রতিদিন এখানে এসেছি ছেলেকে নিয়ে। আজকেও এখানে এসেছি- শুধু শনাক্তের পর স্বামীর লাশটা পাবো বলে।
ছেলের ছবি হাতে রায়ের বাজার কবরস্থানে এসেছিলেন জুলাই আন্দোলনে নিহত সোহেল রানার মা রাশেদা বেগম। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা তিনিও ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আসায় কবরস্থানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ই জুলাই থেকে আমার সন্তান আর ফিরে আসেনি। আমার ছেলে এখানেই আছে। ডিএনএ করুক আর যাই করুক আমি আমার ছেলেকে খুঁজে মরদেহ নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবো। আমি আমার সন্তানকে আমার বুকে আগলে রাখতে চাই। নিহত সোহেল রানার বাবা লাল মিয়া বলেন, আমার ছেলে ১৮ই জুলাই শহীদ হয়। হাসপাতালে আমার ছেলের লাশ পড়ে থাকা একটি ভিডিও দেখে তাকে আমরা শনাক্ত করি। এরপর লাশের জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্তু অনেক আকুতি মিনতি করার পরও তারা আমার ছেলেকে ফেরত দেয়নি। উল্টা হুমকি দিয়ে বলেছে- ওপর মহল থেকে নাকি আমার ছেলের লাশ দিতে নিষেধ করেছে। দিনের পর দিন ঘুরিয়ে পরে বেওয়ারিশভাবে আমার ছেলেকে এখানে দাফন করেছে।
সোহেল রানা, রফিকুল ইসলামের মতো অন্তত ১০টি পরিবারের সদস্যরা তাদের নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে- ফেনীর খুরশেদ আলমের সন্তান টাইলস মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম (২৯), শেরপুর শ্রীবর্দী থানার মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে গাড়িচালক আসাদুল্লাহ (৩১), ঢাকার ডেমরা সারুলিয়া এলাকার মৃত গোলাম মোস্তফা ফারুকীর ছেলে আহমেদ জিলানী, ময়মনসিংহ ফুলপুর থানার ফুলপুর গ্রামের গাজী মাহমুদের সন্তান মাহিম (২৫), কুমিল্লা দেবীদ্বার কাচিমারা এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে আব্দুল্লাহপুর এসএম মোজাম্মেল হক কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল সরকার (২৫), চাঁদপুর বারোহাটিয়া স্যাংগাচর গ্রামের সবুজ ব্যাপারীর সন্তান পারভেজ ব্যাপারী (২৩)’র লাশের জন্য আবেদন করেছে তাদের পরিবার।
এদিকে গতকাল রায়ের বাজর কবরস্থানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ বলেছেন, আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের লাশ উত্তোলন, পোস্টমর্টেম, ডিএনএ স্যাম্পলিংসহ প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, আনাসের মতো যারা বুকের রক্ত ঢেলে দেশের জন্য রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। এই কবরস্থানে যারা নাম-পরিচয়হীন অবস্থায় শুয়ে আছেন, তাদের পরিচয় তখন যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা জাতির কাছে আমাদের একটি দায়িত্ব। আজ সেই মহান কাজের সূচনা হলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার (ওএইচসিএইচআর) মাধ্যমে আর্জেন্টিনা থেকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফান্ডার ঢাকায় এসে পুরো কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি গত ৪০ বছরে ৬৫টি দেশে একই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়াও সিটি করপোরেশন, ঢাকা মেডিকেল, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ডিএমপি, বিভাগীয় কমিশনারসহ সব স্টেকহোল্ডারকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। কবর উত্তোলন থেকে পুনঃদাফন পর্যন্ত নির্দিষ্ট ধাপের সকল কার্যক্রম করা হবে জানিয়ে সিআইডি প্রধান বলেন, আবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ১১৪টি কবর চিহ্নিত হয়েছে, যা বাস্তবে কমবেশি হতে পারে। মৃতদেহ উত্তোলনের পর পোস্টমর্টেম, বোন স্যাম্পল/টিস্যু সংগ্রহ, ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে। পরিচয় নিশ্চিত হলে ধর্মীয় সম্মান বজায় রেখে আবার পুনঃদাফন করা হবে। পরিচয় শনাক্তের পর কেউ যদি লাশ গ্রহণ করতে চান তাহলে গ্রহণ করতে পারবেন। আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ১০ জন স্বজন আবেদন করেছেন, আরও কেউ থাকলে সিআইডিতে যোগাযোগ করতে পারবেন। সিআইডি হটলাইনে যোগাযোগ করলে স্বজনদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- এই প্রক্রিয়ায় সকল শহীদের পরিচয় আমরা বের করতে পারবো। সিআইড প্রধান বলেন, অনেক বাবা-মা, ভাই- বোন বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন তাদের আপনজনদের পরিচয় জানার জন্য। আমরা চাই, এই জাতীয় বেদনার দায় থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারি।
এ সময় ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ইউএনএইচআর) আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফন্ডিব্রাইডার বলেন, আমি গত তিন মাস ধরে সিআইডি’র সঙ্গে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক মানের এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এই কাজ আন্তর্জাতিক ফরেন্সিক মানদণ্ড ফলো করে করা হবে। আন্তর্জাতিক রুলস ফলো করে আমরা লোকাল সংস্থা (সিআইডি)কে সহায়তা করা হবে।