Image description

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের নায়াগ্রা টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করতেন দুই হাজার ৩০০ শ্রমিক। ২৩ নভেম্বর সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে শ্রমিকরা জানতে পারেন তাঁদের আর চাকরি নেই। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। হঠাৎ কারখানা বন্ধ হওয়ায় কঠিন অনিশ্চয়তায় পড়েন শ্রমিকরা।শুরু হয় বেকার জীবন।গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীর জরুণ এলাকার কেয়া গ্রুপের চারটি গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায় গত ২৯ ডিসেম্বর। বেকার হন সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে দুই শতাধিক ছিলেন শ্রবণপ্রতিবন্ধী।দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম বেক্সিমকো গ্রুপ। গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকার বেক্সিমকো শিল্প পার্কের ১৬ পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ৪২ হাজার শ্রমিক। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সালমান এফ রহমান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলে গ্রেপ্তার হন সালমান এফ রহমান।

হত্যা, অর্থপাচার, দুর্নীতি, ঋণখেলাপি ইত্যাদি অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়। তিনি জেলে যাওয়ার পর স্থগিত করা হয় তাঁর ব্যাংক হিসাব। এরপর শুরু হয় বেক্সিমকোর কারখানাগুলোতে অর্থসংকট। বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের নামতে হয় আন্দোলনে। ১৫ ডিসেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ওই ১৬ কারখানা।চাকরি হারিয়ে বেকার হন ৪২ হাজার শ্রমিক।শুধু নায়াগ্রা টেক্সটাইল, কেয়া গ্রুপ আর বেক্সিমকোর ১৬ কারখানাই নয়, গাজীপুরে একে একে বন্ধ হচ্ছে আরো কারখানা। এতে হতাশা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ। কারখানা চালু করার দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন শ্রমিকরা। নেমেছেন আন্দোলনে। বেক্সিমকোর কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে মঙ্গলবার গণসমাবেশ করেন শ্রমিকরা। গণসমাবেশে অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী অংশ নেন। দ্রুত কারখানা খুলে না দিলে বড় ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দেন শ্রমিকরা।

জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায় মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী ৪০ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান পলিকন লিমিটেড। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে একসময়ের সুনামধারী প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরেই আর্থিক সংকটে ছিল। কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন শ্রমিকরা।কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পলিকন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ফয়সাল জহির জানান, ডলার ও গ্যাস সংকট, লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে যায়। ব্যাংক লোন, বকেয়া বেতন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল কোনোটাই সঠিকভাবে পরিশোধ করতে না পারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।পলিকনের প্রবীণ কর্মচারী মেকানিক্যাল বিভাগের মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫৮) বলেন, ‘আমার চাকরির বয়স ৩৭ বছর। এ বয়সে কোথায় চাকরি পাব? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোথায় যাব, ভেবে পাচ্ছি না। গত বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের বেতন এখনো বকেয়া।’ 

 

কাশিমপুরের চক্রবর্তী এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বেক্সিমকোর কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ায় শুধু শ্রমিক নন, হতাশায় পড়েছেন বাড়ির মালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এলাকার বাড়ির মালিকদের আয়ের একটি বড় খাত ছিল বাড়িভাড়া। কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক গ্রামে চলে গেছেন। যাঁরা আছেন তাঁরাও ভাড়া দিতে পারছেন না। অনেক মালিক ব্যাংকঋণ নিয়ে বাড়ি করেছেন। ভাড়া না থাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। অনেক শ্রমিক দোকানের বাকি না দিয়ে চলে গেছেন। বেকারত্বের কারণে এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে গেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুনাক)-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, গাজীপুরকে বলা হয় দেশের অর্থনীতির রাজধানী। রাজধানীর সবচেয়ে কাছের গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন ৭০ লাখের বেশি শ্রমিক। একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় বাড়িভাড়াসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নতুন বিনিয়োগ আনা অথবা বন্ধ কারখানা চালু করা না গেলে সমস্যা আরো তীব্র হতে পারে। এদিকে এখনই দৃষ্টি না দিলে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২-এর পুলিশ সুপার এ কে জহিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ছয় মাসে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হচ্ছে আর্থিক সংকটের কারণে।