Image description

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১ এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন মিজানুর রহমান। নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি চারটি অঞ্চলের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। মিজানের ইচ্ছে ছিল উপকর (পৌরকর) কর্মকর্তা হওয়া। এই পদে যেতে পারলে অবৈধ আয় বেশি হারে করা যেতো। ডিএনসিসিতে এটা প্রচারিত আছে যে, প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের ঘুষের লোভ বেশি। ঘুষ ছাড়া তিনি কোনো কাজ করেন না। এ ধরনের পদায়নে তো ঘুষ অবশ্যই দিতে হবে। তাই, এক লাখ টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে প্রশাসক এজাজকে মোবাইলে ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন মিজান। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। প্রশাসক এজাজ ক্ষেপে গিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ওইদিনই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় মামলাও চালু করা হয়। গত ৮ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান শুরুতে বুঝতে পারেননি নিজের ভুল। পরে তিনি বুঝতে পেরেছেন, ভুলটা কোথায় করেছেন। এজন্য মাফও চেয়েছেন, তবে মাফ পাননি। মোহাম্মদ এজাজের আমলে এই পদে পদায়নের ঘুষের রেট হলো চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তাছাড়া প্রশাসক এজাজ নিজের হাতে সরাসরি নেন না। তিনি ঘুষ নেন মাহবুবুর রহমানের মাধ্যমে। এই মাহবুবুর রহমানই ডিএনসিসি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজের কাজী। তাকে এজাজের আত্মীয় হিসেবেই সবাই জানেন। এজাজের পক্ষ থেকে সকল ধরনের লেনদেন এবং ঘুষের দরকষাকষি মাহবুবের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এটা অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে। মাহবুবুর রহমান ঘুষের টাকাগুলো সংগ্রহ করে সরাসরি এজাজের হাতে দেন না। তিনি অন্য আরেকজনের হাতে দেন, যিনি এজাজের অর্থপাচারসহ সকল অপকর্মের গোপন কাজগুলো করে থাকেন।

প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের হয়ে ডিএনসিসি সংশ্লিষ্ট সকল খাত থেকে বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য করছেন মাহবুব্রু রহমান। এ নিয়ে গত আগস্টে বড় ধরনের এক কেলেঙ্কারিও ঘটে গেছে। গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নগর ভবনে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সভাপতিত্বে বোর্ড সভা চলছিলো। কাওরান বাজারের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী অতর্কিতে জোরপূর্বক বোর্ডসভায় ঢুকে পড়েন। ঢুকেই কয়েক কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উপস্থাপন করেন। একই সাথে উচ্চস্বরে সংক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, “প্রশাসকের আত্মীয় মাহবুবুর রহমান দোকান দেওয়ার কথা বলে প্রশাসকের নামে টাকা নিয়েছেন।” তাদের বক্তব্য হলো, “প্রশাসকের আত্মীয় মাহবুবুর রহমান প্রশাসকের নাম ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদেরকে দোকান দেওয়ার নামে কয়েক দফায় ৫/৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এখনো দোকান দেওয়ার কোন খবর নেই। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া সমুদয় টাকা ফেরত দিতে হবে এবং মাহবুবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ এবং হট্টগোলের ঘটনায় ওইসময় প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ও ডিএনসিসির বোর্ড সভায় অংশ নেয়া ডিএনসিসির বিভাগীয় প্রধান, মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন।

প্রশাসক এক পর্যায়ে সংক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের বলেন, “যে লোক ৫/৬ কোটি টাকা নিয়েছেন তার ছবি এবং নাম পরিচয় দেন। এই বিষয়টি নিয়ে আপনাদের সাথে পরে কথা বলবো। আপনাদের অভিযোগ শুনবো এবং এই বিষয়টি অবশ্যই দেখবো। আপনারা এখন বাইরে চলে যান।” প্রশাসক এবং কর্মকর্তাদের অনুরোধে আশ্বস্ত হয়ে ব্যবসায়ীরা সভা কক্ষ থেকে বাইরে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু সভা শেষে প্রশাসক ব্যবসায়ীদের আর সময় দেননি। তবে পরবর্তীতে সংযুক্ত ব্যবসায়ীদের অন্যভাবে সামাল দেন।

চলতি বছরের শুরুর দিকে মোহাম্মদ এজাজ যখন ডিএনসিসির প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান ওই সময় অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ, তিনি কখনো আলোচনায় ছিলেন না বা চেনামুখ নন। দ্বিতীয়ত, যারা মোহাম্মদ এজাজ সম্পর্কে ভালো করে জানেন এরাও অত্যন্ত অবাক হয়েছেন, এজাজের অতীত জীবন বিবেচনা করে। তিনি ছাত্র জীবনে ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০২ সাল থেকে হিজবুত তাহরীরের সাথে জড়িত হন। এই সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে কমপক্ষে দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন। তবে তাকে এই পদে নিয়োগের সময় অতীত রিপোর্টকে সামনে আনা হয়নি। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) নামে একটি এনজিও’র চেয়ারম্যান, এই পরিচয়টি তুলে ধরা হয়।

জানা যায়, এনজিও’র সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে মোহাম্মদ এজাজের। তিনিই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কাছে সুপারিশ করেন। সজীব ভুঁইয়া অধীন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের জন্য। সেই অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। তবে এটা বহুলভাবে প্রচারিত আছে যে, মোহাম্মদ এজাজ এই পদায়ন পাওয়ার জন্য একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

প্রশাসক এজাজের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এক বছরের চুক্তিতে প্রশাসক হয়েছেন তিনি। একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে এই এক বছরে হাজার কোটি টাকা তুলবেন, এটাই ছিল শুরুতে মোহাম্মদ এজাজের টার্গেট। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে টার্গেটের অনেকটাই তিনি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য, মন্ত্রণালয়কেও নিয়মিতভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হচ্ছে। একদিকে নিজের অবৈধ আয়ের টার্গেট, অন্যদিকে মন্ত্রণালয়কে সন্তুষ্ট রাখা- এসব করতে গিয়ে মোহাম্মদ এজাজ বেপরোয়া দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থের প্রতি প্রশাসক এজাজের লোভ এতোটা বেড়ে গেছে যে, তিনি কোনো আইন-কানুন, নিয়মনীতির ধার ধারছেন না। শীর্ষকাগজের হাতে এ রকমের বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ এসেছে। অবৈধভাবে দোকান বরাদ্দ, ফুটপাত বরাদ্দ, মার্কেট নির্মাণ, ই-রিক্সা প্রভৃতি প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডেই নজিরবিহীন অনিয়ম আর ঘুষের হাট বসিয়েছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মূলতঃ এ কারণেই সরাসরি প্রশাসককে ঘুষের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএনসিসিতে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়নেও ব্যাপকহারে ঘুষ বাণিজ্য চলছে, যা অতীতে এমনটা ছিল না। শুধু নন-ক্যাডারই নয়, সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিতে ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়নেও ঘুষের প্রচলন শুরু হয়েছে। গত সপ্তায় ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদায়ন পেয়েছেন মাদারীপুর স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাবিবুল আলম। প্রশাসনের ২৮তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ডাম্পিং পদায়ন থেকে এই পদে আসতে তাকে বড় অংকের বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তিনি এক সময় ছিলেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের প্রটোকল কর্মকর্তা। কৃষি মন্ত্রণালয়ে শাখায় পদায়নে থাকাকালে আনঅফিসিয়ালি মন্ত্রীর প্রটোকলসহ সকল কাজ দেখাশোনা করতেন। আর এ কারণেই তাকে ডাম্পিং পদায়নে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থের জোরে এখন খোদ ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদায়ন বাগিয়ে নিলেন। তবে ডিএনসিসি সূত্র বলছে, এই পদায়নের অর্থ প্রশাসক পাননি, উপদেষ্টা পেয়েছেন। উপদেষ্টা নিজে উদ্যোগী হয়ে সশরীরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হাবিবুল আলমের ডিএনসিসিতে পদায়নের ব্যবস্থা করেছেন।

শীর্ষনিউজ