Abrer Samin (আবরার মোহসিন সামিন)
ফ্যাসিবাদ পতনের একবছর পুর্তি। প্রথম বর্ষপুর্তিকে আরও বেশি স্মরনীয় করে রাখতে এই দিনেই ফ্যাসীবাদ বিরোধি সকল রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে জুলাই ঘোষনাপত্র পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
একই দিন সকালে এনসিপির বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কক্সবাজার যায়। সফরের কারন জানতে চাইলে তারা বলে, যাস্ট রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য তারা ঘুরতে গিয়েছে।
সেখানে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে তাদের একটি সমঝোতা বৈঠক হয় বলে মেইনস্ট্রীম মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়া তে বেশ আলোচনা হয়। এনসিপি ব্যাপারটি পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং তার পেছনে যুক্তি দেয় পিটার হাস সেই সময় বাংলাদেশ ছিলেন ই না।
দুটো প্রশ্ন সামনে আসে, যার উত্তর খোজার চেষ্টা করতে যেয়ে বেশ চমকপ্রদ কিছু তথ্য খুজে পাই।
১। জুলাই ঘোষনাপত্র যেদিন পাঠ করা হয় সেদিন জুলাইয়ের সম্মুখ সারীর নেতৃবৃন্দ এমনি এমনি কক্সবাজার ঘুরতে যাবে সেটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?
২। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের এই যুগে কোনো মিটিংয়ে এটেন্ড করতে হলে কি সশরীরেই উপস্থিত থাকা লাগে?
আসেন একটু পেছন থেকে শুরু করি, ২০২৩ সালের মার্চ। গ্লোবাল অয়েল আর গ্যাস ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় সাপ্তাহিক, "UPSTREAM" একটি নিউজ করে বাংলাদেশ নিয়ে। সেখানে তারা উল্লেখ করে, "US supermajor ExxonMobil could prove to be the saviour of Bangladesh’s struggling upstream industry, especially if it can unlock the multi-trillion cubic feet of gas reserves that are believed to lie in its offshore waters in the Bay of Bengal"। আরও কিছুদূর এগিয়ে তারা লিখে, "Confirming the move, an ExxonMobil spokesperson told Upstream: “ExxonMobil has held initial discussions with Petrobangla regarding Bangladesh’s plans for an exploration round." এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এর সত্যতা স্বীকার করা হয় সেই সময়, "Petrobangla chairman Zanendra Nath Sarker was quoted by TBS News as saying: “ExxonMobil has placed a primary proposal to negotiate on offshore blocks in [the] deep sea as well as for some onshore blocks."
উক্ত রিপোর্ট থেকে এইটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা থেকে তেল উত্তোলনের জন্য আমেরিকার একটি প্রস্তাব ছিলো, এবং এটি বেশ দূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। কিন্তু ২০২৪ সালের ইলেকশান কেন্দ্র করে হাসিনা সরকারের সাথে দুরত্ব সৃষ্টি হয় মার্কিন প্রশাসনের। পরবর্তীতে ইন্ডিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে ২০২৪ এর পাতানো ইলেকশানের পর সেই তেল এক্সপ্লোর করার দায়ীত্ব পায় ইন্ডিয়ান দুটি কোম্পানি। ইন্ডিয়ার সাথে হাসিনা সরকার এসংক্রান্ত একটি চুক্তি করে, যা বাংলাদেশের জন্য চুড়ান্ত অপমানজন। একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করা হয়, যার ৯০% শেয়ার ইন্ডিয়ার হাতে আর বাংলাদেশের হাতে থাকে মাত্র ১০%। আজকের পত্রিকার একটি রিপোর্টে লিখা হয়, "শেখ হাসিনা সরকারের সময় ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ওভিএল, ওআইএল এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) দুটি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছিল। এতে ভারতীয় কোম্পানি দুটির প্রত্যেকের ৪৫ শতাংশ করে শেয়ার ছিল এবং বাপেক্সের ছিল বাকি ১০ শতাংশ।"
সেই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। ভারতীয় দুই জ্বালানি কোম্পানির পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। ভারতীয় কোম্পানি দুটি হলো ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) এবং অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল)। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমা থেকে তেল উত্তোলনের জন্য কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ নয়।
এই পর্যায়ে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি। আমেরিকায় "রিভলভিং ডোর" নামে একটি আইন আছে, যে আইনে সরকারি দায়িত্ব ছাড়ার পর লবিস্ট হতে নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়; এই আইন অনুযায়ী, দেশটির কোনো আইনপ্রণেতা কিংবা সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব থেকে অবসরের ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লবিস্ট হিসেবে যুক্ত হতে পারবেন না। এই সময়কে আইনে ‘কুলিং অব পিরিয়ড’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মার্কিন সরকারের হয়ে কাজের সময় তৈরি হওয়া প্রভাবের অপব্যবহার ঠেকাতে ১৮৭২ সালে আইনটি করা হয়। বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যেই এই আইনটি আছে। যেসব অঙ্গরাজ্যে আইনটি নেই, সেসব অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন কোনো আইনের মাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এ আইন ভাঙায় গত বছর এক সাবেক মার্কিন কূটনীতিক কে জরিমানা গুনতে হয়। সেই কূটনীতিক যুক্তরাষ্ট্রের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রতিষ্ঠান 'এক্সিলারেট এনার্জি' বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে জয়েন করেন। তিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে জার্মান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জ্বালানিতে বিশেষজ্ঞ না হয়ে, নিজের দেশের আইন ভঙ্গ করে, একটি জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রিহেড হয়ে যাওয়াটা আশ্চর্যের ই বটে। সবশুনে প্রশ্ন জাগতেই পারে কে এই বিশেষ ব্যক্তি? দেশ বিদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা খোজ খবর রাখেন তারা হয়তো ধরতে পেরেছেন উনার পরিচয়। তিনি আজকের লিখার মূল চরিত্র, বাংলাদেশের নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
বাংলাদেশে প্রায় তিন বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে পিটার হাস ২০২৪ সালের ২২ জুলাই দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। এরপর তিনি ২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবসর নেন। এর তিন দিনের মাথায় ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি এক্সিলারেট এনার্জির ওয়াশিংটন ডিসি অফিসে যোগদান করেন। তারপর তিনি আবার ফিরেছেন বাংলাদেশে, প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের প্রধান হয়ে।
সমকাল পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, "বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নাম লেখানো অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এবার একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি বঙ্গোপসগারে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে"। ২০২৪ সালের মার্চে ৯টি অগভীর ও ১৫টি গভীরসহ সমুদ্রদের মোট ২৪টি ব্লক ইজারা দিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়; যেজন্য শেষ সময় বেঁধে দেওয়া হয় ৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু কোনো এক ইশারায় এই সময় আরও তিন মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়। যার ফলে এতে অংশ নিতে পারে মার্কিন কোম্পানি।
এনসিপি নেতৃবৃন্দের সাথে কথিত (!) বৈঠকের একমাস পার হওয়ার আগের পিটার হাস কক্সবাজার, মহেষখালী যান। সময় টিভির রিপোর্ট অনুযায়ী, "পিটার হাস বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার বিমান বন্দরে পৌঁছেন। তার সঙ্গে আরও ২ জন ব্যক্তি রয়েছেন"। সেখানে বলা হয়, "সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি ‘এক্সিলারেট এনার্জি’র স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজর হিসেবে মহেশখালী পরিদর্শন গেছেন।"
এখন এনসিপি নেতৃবৃন্দ দাবি করতেই পারে জুলাই ঘোষনাপত্র পাঠের দিন তারা হাওয়া খেতে কক্সবাজার গিয়েছিলো। তারা এও দাবি করতে করেতে পারে পিটার হাসের সাথে তাদের ভার্চুয়ালি কোনো মিটিং ও হয়নি। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় সমুদ্রের ব্লক ইজারা দেয়ার দরপত্র আহ্বানের সময়সীমা তিন মাস বৃদ্ধি, যার ফলে মার্কিন কোম্পানির দরপত্র সংগ্রহ এবং সর্বশেষ তাদের কক্সবাজার যাওয়ার একমাস পার হবার আগেই পিটার হাসের আকষ্মিক কক্সবাজার গমন বেশ ইঙ্গিতপুর্নই বটে।
৫ আগস্ট, ২০২৫
