নামাজে কাতার সোজা রাখা ও গায়ে গা মিলিয়ে দাঁড়ানো কেবল ইবাদতের বাহ্যিক শৃঙ্খলাই নয়, বরং মুসলমানদের হৃদয়ে ঐক্য, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের এক বাস্তব প্রতীক। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই সুন্নাহর প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন।
হাদিসে মহানবী সতর্ক করেছেন: “তোমরা কাতার সোজা করবে, না হলে আল্লাহ তোমাদের মুখমণ্ডলে (অন্তরে) বিভেদ ঘটিয়ে দেবেন।” (সহিহ বুখারি ৭১৭, সহিহ মুসলিম ৪৩৬)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন: “আমরা নামাজে এমনভাবে দাঁড়াতাম যে, আমাদের একজন তার কাঁধ অপরের কাঁধের সাথে এবং পা অপরের পায়ের সাথে মিলিয়ে রাখত।” (সহিহ বুখারি ৭২৫)
ইমাম নববী (রহ.) তার “শরহ মুসলিম”-এ উল্লেখ করেছেন, কাতার সোজা রাখার উদ্দেশ্য হলো হৃদয়ে ঐক্য সৃষ্টি ও অহংকার দূর করা। কাতারে গায়ে গা মিলিয়ে দাঁড়ানো মানুষকে অহংকার থেকে দূরে রাখে, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা জাগায় এবং ধনী-গরিব, নেতা-জনতা, কালো-সাদা সবাইকে সমান মর্যাদায় আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়।
ইমাম ইবনে হাজার আল আসকালানী (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন, কাতারে ফাঁক রাখলে শয়তান প্রবেশ করে এবং মানুষের হৃদয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই ব্যাখ্যা ইসলামী বিশ্লেষকদের মতে কাতার সোজা রাখার সুন্নাহর নেগেটিভ দিককে স্পষ্ট করে।
হাদিস অনুযায়ী নবী বলেছেন: “কাঁধ কাঁধে মিলিয়ে দাঁড়াও, ফাঁকা স্থান পূরণ করো, কারণ শয়তান ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে।” (সহিহ মুসলিম ৪৩৫)
ইমাম ইবনে হাজার আল আসকালানী (রহ.) (ফাতহুল বারী, খণ্ড. ২, পৃ. ২০৯) উল্লেখ করেছেন, “এই নির্দেশনার উদ্দেশ্য হলো অন্তরের ঐক্য রক্ষা করা এবং শয়তানের বিভেদ সৃষ্টির পথ বন্ধ করা।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাতার সোজা রেখে নামাজ আদায় করলে সমাজে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। মসজিদে সমান কাতারে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে মুসলমানরা শিখে নেয় সামাজিক সমতা ও ভ্রাতৃত্বের পাঠ। এতে সমাজে দূর হয় হিংসা, হানাহানি ও শ্রেণি-বৈষম্যের দেয়াল।
তবে আজ অনেক জায়গায় দেখা যায়, নামাজে কাতার সোজা রাখা ও গায়ে গায়ে মিলিয়ে দাঁড়ানোর সুন্নাহটি অবহেলিত হচ্ছে। ফলে কাতারে ফাঁক রয়ে যায়, যা নবীর সতর্কবার্তা অনুযায়ী বিভেদ ও শয়তানের প্রবেশের পথ খুলে দেয়।
ইমাম নববী (রহ.) এবং অন্যান্য বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, এই অবহেলা কেবল নামাজের আদব নষ্ট করে না, বরং মুসলমানদের অন্তরেও অনৈক্যের বীজ বপন করে। মুসলমানদের ঐক্য রক্ষায় এই নববী শিক্ষা আজ আগের চেয়েও বেশি প্রয়োজন। যদি মসজিদের কাতারগুলো এক হয়, তবে মুসলমানদের হৃদয়ও এক হবে আর এক কাতারে দাঁড়ানো মানুষ বাস্তব জীবনেও একে অপরের পাশে দাঁড়াবে।
অতএব, নামাজের কাতারে গায়ে গা মিলিয়ে দাঁড়ানো কোনো ছোট বিষয় নয়। এটি একদিকে নামাজের সৌন্দর্য ও পূর্ণতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে মুসলিম সমাজে ভালোবাসা, বিনয় ও ঐক্যের শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। নববী এই নির্দেশনাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধারণ করতে পারলেই মুসলমানরা ফিরে পেতে পারে সেই আদর্শ ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি, যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন রাসূলুল্লাহ ও তার সাহাবিগণ।