Image description

গত ২৩ অক্টোবর  নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ (আরপিও) সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, যদি নির্বাচনী জোট হয়, তাহলে জোটের অংশ হলেও দলের যে প্রতীক তা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে, যাতে ভোটাররা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন প্রার্থী কোন দলের। কিন্তু এ বিষয়ে আবারও পরিবর্তন আনা হয়েছে। গতকাল সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এসংক্রান্ত আগের বিধানটিই ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ  জোটভুক্ত  নিবন্ধিত দলগুলোর প্রার্থীরা চাইলে জোটের অন্য দলের প্রতীকেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।

গত ২৩ অক্টোবর জোটের ভোটে নিজ নিজ দলের প্রতীক ব্যবহারে  বাধ্যবাধকতার প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদে পাস হলে বিএনপি ও তাদের সম্ভাব্য জোটভুক্ত দলগুলো এর প্রতিবাদ জানায়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি পক্ষে অবস্থান নেয়। এ বিষয়ে দুই পক্ষ থেকেই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে তাদের দাবি অব্যাহত রাখে। গতকালও ১২  দলীয় জোট থেকে সিইসিকে চিঠি দিয়ে  এই দাবি জানানো হয় যে, জোটবদ্ধ নির্বাচনে শরিক দলগুলোকে জোটের যেকোনো দলের প্রতীকে ভোট করার সুযোগ দিতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়, ‘আরপিও সংশোধনীর অনুচ্ছেদ-২০-এ জোটগত নির্বাচন বিষয়ে বলা হয়েছে,  জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও তাঁকে নিজের দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আমরা এ পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করছি। অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের বা  জোটের অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার।

এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে এর আগে কোনো সমস্যা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এ প্রক্রিয়া পরিবর্তনের  কোনো দাবি ছিল না। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনাকালে আরপিওর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে  কোনো পরিবর্তন আনা হবে না বলে বিএনপিসহ আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পত্রিকায় খবর এলো  যে  জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে। আমরা মনে করি, জোট গঠনের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয়ী হওয়া।
জোটবদ্ধ দলগুলোর পছন্দ অনুযায়ী প্রতীক চাওয়ার অধিকার আছে। এভাবেই এত দিন প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এতে কোনো সমস্যা হয়নি। এই প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা  কেন  দেখা দিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রধান অংশীজন অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনভিপ্রেত এবং আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।’

আরপিওতে আর যেসব পরিবর্তন এসেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) দায়িত্ব পালন করবে। ফলে এই তিন বাহিনীর সদস্যরাও গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসহ পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তাঁদের নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া মামলায় পলাতকদের  নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারাসহ বেশ কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার  প্রেস সচিব শফিকুল আলম এই পরিবর্তন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানান।

ওই দিন আইন উপদেষ্টা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যে সংজ্ঞা, সেখানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত যেসব বিধান ছিল তা বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় পলাতক ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না, এটিও যুক্ত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন গত ১১ আগস্ট আরপিও সংশোধনের জন্য যেসব প্রস্তাব অনুমোদন করে তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ছিল। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুসারে এই প্রস্তাবটি ইসির সভায় অনুমোদন করা হয়। উপদেষ্টা পরিষদে ইসির আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের পর তা  রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পথে। ১৬ বছর পর সশস্ত্র বাহিনী এই ক্ষমতাটি আবারও ফিরে পেতে যাচ্ছে।

২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরপিওর ৮৭ অনুচ্ছেদে এই বিধান যুক্ত করা হয় যে, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা না হয়েও নির্বাচনী অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন। ২০০১ সালে এই বিধান অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে যুক্ত করা হয়। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলোতেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ বাদ দেয়। এর ফলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের যে ক্ষমতা তা সশস্ত্র বাহিনীর থাকে না।

এদিকে পলাতক আসামিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাবটি ছিল মূলত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের। নির্বাচন কমিশন প্রথমে এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছিল। গত মার্চে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে লিখিতভাবে ইসি বলেছিল, এমন বিধান অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, এটি নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের  প্রয়োজন রয়েছে।

কিন্তু পরে  ইসি এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ বিষয়ে  নির্বাচন কমিশনার  আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আলোচনা করেছে। আলোচনায় উভয় কমিশন সন্তুষ্ট হয়েছে এবং মনে করেছে এমন বিধান রাখা ভালো হবে।

আরপিও সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে আইন উপদেষ্টা আরো জানিয়েছিলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত বিধান বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে তাঁদের দেশি ও বিদেশি আয়ের উৎস, সম্পত্তির বিবরণ এবং আর্থিক তথ্য নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। এসব তথ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে, যাতে জনগণ তা জানতে পারে। প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। নতুন করে ‘না ভোট’ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদি কোনো আসনে একজন প্রার্থী থাকেন, ভোটাররা চাইলে ‘না ভোট’ দিতে পারবেন। যদি ‘না ভোট’ বেশি হয়, তাহলে সেই আসনে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যাতে ২০১৪ সালের মতো বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা আর না ঘটে।

এ ছাড়া পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা এবার পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। গণমাধ্যমের কর্মীরা এখন থেকে ভোট গণনার স্থানে উপস্থিত থাকতে পারবেন, যা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করবে।

এ ছাড়া রাজনৈতিক দলকে ৫০ হাজার টাকার বেশি দান, অনুদান বা চাঁদা দিতে হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দিতে হবে। দাতা ব্যক্তিকে তাঁর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। আগে নির্বাচন কমিশন শুধু কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলে সেই কেন্দ্রের ফল বাতিল করতে পারত। এখন থেকে কমিশন মনে করলে পুরো নির্বাচনী এলাকায় অনিয়ম হয়েছে, তাহলে তারা সম্পূর্ণ এলাকার নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা পাবে।