দেশে দিনদিন বাড়ছে অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সংখ্যা। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এসব হত্যার পেছনে জড়িতরা বিচারের আওতায় আসছে না। এছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সহিংসতা এমনকি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা এখনো ঘটেই চলছে। এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন ও মানবাধিকার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এসব ঘটনার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না সরকার ও সংশ্লিষ্টরা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম-খুনের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের পতন ঘটে। এরপর নতুন করে সরকার পরিচালনার জন্য শপথ নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই সেই সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পরও বন্ধ হয়নি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কায়দায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটত-এ সরকারের সময়ে সেভাবে হচ্ছে না। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। হেফাজতে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে, নদীতে লাশ ভাসছে। এসবের দায় অন্তর্বর্তী সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানে আমাদের দেশের মানুষ বুঝে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কিংবা হেফাজতে মৃত্যুকে। মূলত আদালতের রায়ের বাইরে সব ধরনের হত্যাকাণ্ডই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর অজ্ঞাতপরিচয় লাশের খবর মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে লাশের সংখ্যা বাড়বে, অপমৃত্যু বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৩৪টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়েছে। এসব মানুষের অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার। এসব লাশ উদ্ধারের পর অধিকাংশেরই নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ফলে এসব লাশ ‘অজ্ঞাত’ হিসাবেই দাফন করা হয়। এতে জীবন হারানোর পাশাপাশি মুছে যায় এসব মানুষের অস্তিত্ব। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘাতকরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী কিংবা বড় শহরে এসে জীবিকার সন্ধানে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন। অনেকের লাশ উদ্ধার হলেও তাদের পরিচয় মেলে না। এতে পরিবার হারাচ্ছে প্রিয়জনকে, আর সমাজ হারাচ্ছে একেকটি নাম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লাশ শনাক্তে জাতীয় ডেটাবেজ ব্যবস্থার অভাব, ডিএনএ টেস্টে বিলম্ব এবং অনেক পরিবারের অভিযোগ না করা-এসব কারণে অধিকাংশ অজ্ঞাতপরিচয় লাশের রহস্য উন্মোচন সম্ভব হয় না।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ বেড়ে যাওয়া শুধু মানবিক সংকট নয়; এটি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবিও। যতদিন পরিচয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার না হবে, ততদিন এ লাশের মিছিল থামবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে বর্তমানে ২৪টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ রয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে ছয়টি এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) মর্গে আরও কয়েকটি লাশ শনাক্তের অপেক্ষায়।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ৩৮৬টি এবং জুরাইন কবরস্থানে ৭৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কয়েকটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সৎকার হয়েছে পোস্তগোলা শ্মশানে।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের দাফন কর্মকর্তা মো. কামরুল আহমেদ বলেন, পুলিশের অনুমতি পেলেই নিজস্ব গাড়িতে করে নির্ধারিত কবরস্থানে আমরা অজ্ঞাতপরিচয় লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি।
নৌপুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০১টি লাশ উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে ৯২ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। নৌপুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, নদীতে ভাসমান লাশের পরিচয় শনাক্ত করা খুবই চ্যালেঞ্জের কাজ। অনেক সময় পানি ও পোকামাকড়ের কারণে দেহ পচে গিয়ে আঙুলের ছাপ মুছে যায়, ফলে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশের থানাগুলোয় দৈনিক গড়ে ৮৩টি অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হচ্ছে। এসব অপমৃত্যুর মধ্যে প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি লাশ বেওয়ারিশ থাকছে।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলেছে, ‘অজ্ঞাতপরিচয় লাশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হয়েছে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪০ জন। এর মধ্যে নির্যাতনে মৃত্যু ১৪ জনের, গুলিতে ১৯ জন এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের। একই সময়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ১৫৩ জনের। আর রাজনৈতিক সহিংসতায় সারা দেশে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৯৯৮ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, প্রতিটি ঘটনাকেই পুলিশের পক্ষ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ ও তদন্তের মাধ্যমে যাচাই করে দেখা হয়। কোথাও যদি পুলিশের হেফাজতে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পুলিশে হস্তান্তরের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটি গুরুত্বসহকারে তদন্তের আওতায় এনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অজ্ঞাতপরিচয় লাশের ব্যাপারে তিনি বলেন, কোনো লাশ পাওয়া গেলে প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। পচে-গলে যাওয়াসহ নানা কারণে অনেকের পরিচয় অশনাক্ত থেকে যায়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর-তিন মাসে ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হত্যার শিকার হয়েছেন। নিহতদের তিনজনকে নির্যাতন, ৬ জনকে গুলি এবং ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২১ জুলাই মিরপুর-১ নম্বরে যুবদলের তিন নেতাকর্মীকে ৩০ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শাহআলী থানায় হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু থানায় আসামিরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আসিফ সিকদার নামে একজনের মৃত্যু হয়। তার পরিবারের দাবি, নির্যাতনে আসিফকে হত্যা করা হয়েছে।
১ আগস্ট খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগের বাসা থেকে নজরুল ইসলাম মোল্লা নামে এক ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রী আকলিমা বেগমকে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। স্বজনদের অভিযোগ, নির্যাতনের কারণে নজরুলের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নিলফামারীতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাবিবুর রহমান নামে এক শ্রমিক মারা যান।