দেশে গ্যাসসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর বহু এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ এখন এতই কম থাকে যে, দিনে চুলাই জ্বালানো যায় না। গ্যাসের কারণে সক্ষমতার পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারছেন না শিল্প মালিকরা। মাত্র ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছে শিল্প কারখানাগুলো। একই কারণে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকছে সার কারখানাও। গ্যাসের সংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও অলস বসে আছে। আর চাহিদা মেটাতে সরকার বিদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কার্গো আমদানিতে বাধ্য হচ্ছে। যার চাপ সরাসরি পড়ছে অর্থনীতিতে। এর সঙ্গে ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা পানির তীব্র সংকট।
বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৮০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৭১৬ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে আসছে ১ হাজার ৭৫৬ কোটি ঘনফুট। বাকি ৯৬০ কোটি ঘনফুট জোগান দেওয়া হচ্ছে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। সব মিলে গ্যাসের ঘাটতি ১ হাজার ৮৪ কোটি ঘনফুট। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বর্তমানে বছরে দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে।
গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর আবাসিকের গ্রাহকরা আছেন চরম দুর্ভোগে। দিনের বেলা গ্যাস থাকে না বললেই চলে। আর যতটুকু পাওয়া যায় তা দিয়ে রান্নার কাজ করা যায় না। সামান্য পানি গরম করতেই অনেক সময় লাগে। প্রতিবার শীত এলে নগরবাসী গ্যাসের সংকটে ভোগেন। কিন্তু চলতি বছরে শীত আসার আগে থেকেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ঢাকার হাজীবাগ, যাত্রাবাড়ী, আজিমপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, বাড্ডা, আরামবাগ, খিলগাঁও ও বাসাবো, বনশ্রী এলাকায় বাসিন্দারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গ্যাসের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। গ্যাস সংকটে অনেকে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা, মাটির চুলা, রাইস কুকারের মতো বিকল্প ব্যবস্থায় ঘরে রান্নাবান্নার কাজ সারছেন। এতে খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে গ্যাসের চুলার বিল অন্যদিকে ইলেকট্রিক চুলাসহ অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থায় খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাহকরা বিরক্ত। গ্যাস সংকটের কারণে সরকার চাহিদা মেটাতে ২০২৫ সালে রেকর্ড পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে। জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ৩৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করা হয়। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২১টি। শুধু আগস্টেই ৩ হাজার ৪২৭ এমএমসিএফ এলএনজি ক্রয় করা হয়েছে যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এর পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২৬ সালে আমাদের পরিকল্পনা আছে ১১৫টি এলএনজি কার্গো আনার। আর ২০২৫ সালে ১০৮টি। প্রতি বছর ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে প্রাকৃতিক গ্যাস কমছে। আর ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হচ্ছে ২৪ কার্গো এলএনজির সমান। চাহিদা অনুযায়ী আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ দিনদিন কমছে। আর এ কারণে প্রতি বছর এলএনজি আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অর্থনীতির ওপরও চাপ পড়ছে।
গ্যাস ঘাটতির কারণে বছরে দেশের অধিকাংশ সার কারখানাগুলোও সক্ষমতার সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারছে না। আবার চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গ্যাসের ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন ইউরিয়ার চাহিদা আছে। যার ৫০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। নতুন নির্মিত ঘোড়াশাল সার কারখানা ছাড়া বাকি সব কারখানাই সক্ষমতার চেয়ে কম সার উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তথ্য বলছে, সরকার গত অর্থবছরে বিদেশ থেকে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানি করেছে। আর বসিয়ে রেখে কারখানাগুলো কর্মীদের বেতন ও কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহন করছে।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ আছে। এতে বিনিয়োগও থেমে আছে। বাড়ছে না নতুন কর্মসংস্থান। কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই থাকার কথা। কিন্তু এখন পাওয়া যাচ্ছে ৩ থেকে ৫ পিএসআই। সিএনজি, এলপিজি ও ডিজেল দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখতে গিয়ে মালিকদের অনেকে হিমশিম খাচ্ছেন। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আগের চেয়ে অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও গ্যাস সংকটে শিল্প মালিকদের দুর্যোগের সমাধান হয়নি। এখনো প্রায়ই সময় শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ থাকে না। ১৫ পিএসআই চাপ পাওয়ার কথা থাকলেও আমরা তিন থেকে চার পিএসআই চাপ পাই। এখন ৩৩ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছি। যে পরিমাণ উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। এতে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি। একটি কারখানার সক্ষমতার ৮০ শতাংশ উৎপাদন যদি করতে না পারি তাহলে শিল্প মালিকদের ক্ষতি হয়। এ কারণে এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। আরও অনেকগুলো বন্ধ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে আছে।
গ্যাস নিতে রাজধানী সিএনজি স্টেশনগুলোতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িচালকরা দাঁড়িয়ে থাকছেন। সিএনজি স্টেশন মালিকরা জানান, সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি ১৫ পিএসআই গ্যাস সরবরাহের কিন্তু অনেক বছর ধরেই তা দেওয়া হচ্ছে না। আগে ৫ থেকে ৭ পিএসআই গ্যাসের চাপ পেলেও এখন দিনে ২ থেকে ৩ পিএসআই-এর ওপর উঠছেই না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই পানির সংকট ছিল যা বর্তমানে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। ঢাকার হাজারীবাগ, ঝিগাতলা, লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন পানির জন্য তাদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। টানা কয়েক দিন ধরে ওয়াসার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিক আমির খসরু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘এক ফোঁটাও পানি নাই লালমাটিয়ার বি ব্লকসহ বিশাল এলাকায়। ওয়াসাসহ দেখার কি কেউ নাই?’ তাঁর পোস্টের নিচে মাহবুব আলম নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, ‘পাশেই ওয়াসা, তাও দেখার কেউ নাই।’ লালমাটিয়ার স্থানীয়রা জানান, পানির সংকট নিয়ে বহুবার অভিযোগ জানালেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।