“ইকবাল আমার কাছে জানতে চাইল–এই পরিকল্পনার লিডার কে হবেন? তাকে বোঝালাম এটা ক্যু নয়। আমরা কারেকটিভ অ্যাকশনের চিন্তা করছি। শুদ্ধি অভিযান।”
ঢাকা তখন এক অস্থির নগরী। সেনাবাহিনীর ভেতরে বইছে পাল্টাপাল্টি কয়েকটি স্রোত। অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে ইতিহাসের নতুন এক আবর্তের দিকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট তখনকার রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর প্রেসিডেন্ট পদে অসীন হন তারই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তবে দেশ চলছিল একদল সেনা কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি অংশ তখন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়; বাকিরা কারাগারে কিংবা প্রাণভয়ে আত্মগোপনে। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ ৩ নভেম্বর ভোরে ঘটনাপ্রবাহের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ওই অভ্যুত্থানে বন্দি হন সেই সময়ের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা নিরাপদে দেশের বাইরে চলে যায়। তিন দিনের মাথায় পাল্টা অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদ মোশাররফ। সেই ঘটনাপ্রবাহ জিয়াকে নিয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রে।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে বিমান বাহিনীর অফিসারদের একটি অংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এয়ারফোর্সের এ গ্রুপটির সমন্বয় করছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান বীর উত্তম। তিনি তখন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট।
পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এ অফিসার পশ্চিম থেকে পালিয়ে এসে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এয়ারফোর্সের সদস্য হলেও একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন পদাতিক বাহিনীতে, ফার্স্ট বেঙ্গলে। স্বাধীনতার পর তিনি আবার এয়ারফোর্সে ফিরে যান।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম চরিত্র লিয়াকত আলীকে ৭ নভেম্বরের পর কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয় তার। পরে কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও চাকরি ফেরত পাননি, মেলেনি কোনো সুবিধাও।
বর্তমানে প্রবাসে বসবাস করছেন সাবেক স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত আলী খান। গত বছর দেশে এলে তার মুখোমুখি হন লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সালেক খোকন।
অর্ধশত বছর আগে সেই ৩ নভেম্বর সামরিক বাহিনীতে আসলে কী ঘটেছিল? কেন সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হল? বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কীভাবে দেশ ছাড়ল? তখনকার বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এরকম নানা প্রসঙ্গ, যা অন্ধকার সেই সময়ের ইতিহাসে নতুন আলো ফেলতে পারে।
লিয়াকত আলী খান মনে করেন, সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল মূলত খালেদ মোশাররফের দ্বিধার কারণে। সুযোগ থাকলেও তিনি সমঝোতার পথে যান, তার মাশুল তাকে দিতে হয় নিজের এবং আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রাণের বিনিময়ে।
সালেক খোকন: স্বাধীন দেশের বিমানবাহিনী কেমন ছিল?
লিয়াকত আলী খান: দেখুন, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সারেন্ডার করেছে, কিন্তু পরে এসে সিনিয়র হয়ে বসেছে– এমন বাঙালি অফিসারও ছিল বাহিনীতে। যেমন, একাত্তরে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এমজি তাওয়াব (মুহাম্মদ গোলাম তাওয়াব)। উনি পাকিস্তানের কোয়েটা বেইজে কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। একাত্তরের অগাস্টে পাকিস্তান এয়ারফোর্স থেকে সকল সুবিধাসহ রিজাইন দিয়ে চলে যান জার্মানিতে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরলে বঙ্গবন্ধু তাকে বিমানের এমডি বানান। পরে আবারও জার্মানি চলে যান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই খন্দকার মোশতাক ফিরিয়ে আনেন তাওয়াব সাহেবকে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন থেকে পদোন্নতি দিয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল করেন। পরে তাকে এয়ার চিফও বানান মোশতাক। [বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন মোশতাক। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট তখনকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকেছিলেন মাত্র ৮৩ দিন।]
সেরকম গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস একাত্তরের পুরো নয় মাস দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করেছেন আমাদেরই বিরুদ্ধে। পাকিস্তান সরকার তার কর্মের জন্য অ্যাওয়ার্ডও দিয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর তাকেই ডাইরেক্টর এয়ার ইন্টেলিজেন্স বানানো হয়।
এয়ারফোর্সের চিফ তখন ছিলেন খন্দকার সাহেব (এ কে খন্দকার)। সদরুদ্দীন সাহেব প্রমোশন পেয়ে বেইজ কমান্ডার হয়ে গেলে পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে জয়েন করেন শওকত সাহেব। ফাইটার স্কোয়াডের দায়িত্ব নেন তিনি। তার পরই ছিল আমার অবস্থান। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলাম পরে স্কোয়াড্রন লিডার পর্যন্ত হয়েছি।
একাত্তরে পাকিস্তানে আটকা পড়া এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসাররা মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭৪ সালে। এসেই তারা বিমানবাহিনীতে পজিশনসহ সবকিছু পেয়ে যান। এয়ারফোর্স তো তখন ছোট। সেটা বাড়াতে হলে তাদেরও নিতে হবে। এই যুক্তিতে এটা ঠিক আছে। এরই মধ্যে যারা মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন তাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়। কিন্তু তারা ফেরত আসার পর এটা নিয়ে একটা টেনশনও সৃষ্টি হল।
তাদেরকে যার যে পজিশন ও র্যাংক ছিল, তাই-ই দেওয়া হয়। প্লটসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও তারা পায়। শুধু দুই বছরের সিনিয়রিটি ছিল না। তাদের মধ্যে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস, গ্রুপ ক্যাপ্টেন শওকত, উইং কমান্ডার রকিব, আলতাফ চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। এরপর মুজিব বাহিনীকেই রক্ষীবাহিনী করে ফেলা হল। তখন অনেকের ভেতরই হতাশা তৈরি হল। এসব ঘটনা আমাদের ভেতরও ডিভাইডেশন তৈরি করে দেয়।
সালেক খোকন: ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আপনারা তো ডিফেন্সের ভেতরেই ছিলেন। আগে থেকে কিছু অনুমান করতে পেরেছিলেন?
লিয়াকত আলী খান: মুক্তিযুদ্ধ করেছি ফার্স্ট বেঙ্গলে। ফলে আর্মির অনেকের সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যোগাযোগটা ছিল। বিশেষ করে মেজর কাইয়ুম, মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মেজর ইকবাল প্রমুখের সঙ্গে। হাফিজ মুক্তিযুদ্ধে আমার সাথেই আহত হয়। ফলে স্বাধীনতার পরও নানা বিষয়ে কথা হত।
হাফিজ তখন ৪৬ বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজর। কর্নেল শাফায়াত জামিল [শাফায়াত জামিল ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত ছিলেন। ৭ নভেম্বর আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানে তিনি বন্দি হন।] বিগ্রেড কমান্ডার। হাফিজের বাসায় আমরা যেতাম নিয়মিত। ভেতরে কী হচ্ছে তা নিয়ে কথা হত। তবে সে বেশ চুপচাপ থাকত। মেজর ফারুক (সৈয়দ ফারুক রহমান), ডালিম (শরিফুল হক ডালিম), নূর (নূর চৌধুরী) এরাও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা। ফলে কলিগ হিসেবে জানাশোনা ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করলেন, রক্ষীবাহিনীও হল, তখনই তারা খুব আপসেট হয়ে যান।
সালেক খোকন: ওইদিন আপনি কোথায় ছিলেন?
লিয়াকত আলী খান: ১৫ অগাস্ট ভোরবেলা বাসায় জিপ এল। আমার কোয়ার্টার তখন ছিল ক্যান্টনমেন্ট পোস্ট অফিসের পাশে। তবে রাতে কিছুই টের পাইনি। সম্পর্ক থাকলেও এটা নিয়ে সেনাবাহিনীর কেউ আগে কথাও বলেনি।
আমি গাড়িতে করে ফাইটার স্কোয়াডে চলে আসি, ৪৬ বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারের পাশে। তখনই খবর পাই বঙ্গবন্ধুকে মারা হয়েছে। সবাই শকড হয়ে গেলাম। অপজিটে ফোর্থ বেঙ্গল। সেখানে গিয়ে দেখি মেজর হাফিজ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল তারাও বেশ কনফিউজড হয়ে আছে।
সালেক খোকন: তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ কি চাইলে এ হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পারতেন?
লিয়াকত আলী খান: হয়ত পারতেন। কিন্তু আমার মনে হয় ব্যক্তিগতভাবেই তিনি বেশি ভীত হয়ে ছিলেন। আর ডালিমরা ছিল বেশ হট হেডেড। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা সাহসী ছিল। ফারুকও অনেকটা ক্র্যাক। তারা একটা দুটো ট্যাংকও নিয়ে আসে। এ কারণে কে এম সফিউল্লাহও ভয়ে থাকতে পরেন।
আর্টিলারি ও ট্যাংক রেজিমেন্ট দুটোই ছিল ওদের দখলে। ফলে তখন ফোরটি সিক্স বিগ্রেড আর এয়ারফোর্সকে অ্যাকটিভ করা গেলে অনায়াসে ওদের ট্যাংক রেজিমেন্টকে পরাভূত করা যেত বলে মনে করি।
সালেক খোকন: সেই হত্যাকাণ্ডে বাইরের কোনো শক্তি কি যুক্ত ছিল মনে করেন?
লিয়াকত আলী খান: প্রকাশ্যে কিছু দেখিনি। তবে পরে বুঝেছি এটা সিআইএর প্ল্যান। তা না হলে এত সাহস কোথা থেকে পেল। ইন্ডিয়াও ঘাবড়ে গেছিল। কারণ তারা দেখল, মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লেগেছে। আর তখন প্রো-ইন্ডিয়ান কেউ ছিল না এখানে। এটা তারা বঙ্গবন্ধুকেও বলেছিল। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। ওভার কনফিডেন্ট ছিলেন। তাকে বাঙালি মারবে–এটা বিশ্বাসই করেননি। অথচ তার ক্লোজ লোকরাই তাকে হত্যা করল।
সালেক খোকন: তখন আপনাদের পক্ষে কোনো প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল?
লিয়াকত আলী খান: কিছু করার মত পরিস্থিতি ছিল না তখন। ওরা মিগ আর হেলিকপ্টারের দিকে ট্যাংক ফিট করে গোলাবারুদ আটকে রেখেছিল।
সালেক খোকন: আপনারা তখন কী করলেন?
লিয়াকত আলী খান: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকদিন বেশ শকড ছিলাম। ডালিমরা তখন বঙ্গভবনে চলে গেছে। কেন তারা সেখানে যাবে? তারা তো আর্মির লোক। তখন বুঝলাম এটা বড় ধরনের কনসপিরেসি। হত্যার কারণ তখনই স্পষ্ট হতে থাকে। লোকমুখে গল্প আসছিল কীভাবে তারা শিশু রাসেলসহ অন্যদের মেরেছে। সপ্তাহখানেক পর হত্যা নিয়ে আরও স্পষ্ট হই। তখনই আমি, মেজর হাফিজউদ্দিন, ইকবাল, মিজান, দুই তিন লেভেলের অফিসাররা, কর্নেল শাফায়াত জামিল আর এয়ারফোর্সে আমার কলিগরা কিছু একটা করার চিন্তাভাবনা করি।
সালেক খোকন: কীভাবে এগোলেন?
লিয়াকত আলী খান: প্ল্যান শুরু করলাম সেপ্টেম্বরে। একদিন হাফিজ আমাদের সামনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে, “আমি কথা বলেছি। হি ইজ টেকিং কেয়ার অব দেম।”
এভাবে গেল কয়েকদিন। হাফিজ একদিন বললেন, “সবগুলোকে হেয়ার কাট করাবেন। জিয়ার নিজস্ব আইডিয়া ও পরিকল্পনাও আছে।”
আমরা ভাবছিলাম জিয়া উইল এস্টাবলিশ চেইন অব কমান্ড। সেখানে শাফায়াত জামিলও তাই ভাবল। কিন্তু জিয়ার সঙ্গে আমাদের সরাসরি কথা হয়নি, একমাত্র লিংক ছিল মেজর হাফিজ।
সালেক খোকন: আপনাদের মূল চাওয়াটা কী ছিল তখন?
লিয়াকত আলী খান: চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলে জিয়া আমাদের পক্ষে থাকবেন। ডালিমরা আগে বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসুক। ফিজিক্যালি বঙ্গভবনে গিয়ে ওদের ধরা যাবে না। ক্যান্টনমেন্টে এলে টাইম বুঝে আমরা ওদের অ্যারেস্ট বা অন্য কিছু করব। এই আইডিয়া নিয়ে মিটিং হচ্ছিল হাফিজের ওখানে। দুই তিনজন করে বসতাম। তবে পুরো গ্রুপ একসঙ্গে কখনও বসিনি।
সালেক খোকন: এয়ারফোর্সের গ্রুপটিতে কারা ছিল?
লিয়াকত আলী খান: বেছে বেছে এয়ারফোর্সে আমার কলিগরা সবাইকে মেন্টেলি রেডি করে ফেলল। সবাই জানে আমরা কিছু একটা করব। সাত-আটজন; আমি, বদরুল আলম, জামান, ইকবাল রশিদ, ওয়ালি, সালাউদ্দিন, কাইয়ুম, সিগন্যাল অফিসার মিজান। এই সাতজন কোর। তবে বিভিন্ন লেভেলে আরও লোক ছিল। বিমান এয়ারলাইনসে বন্ধু ছিলেন কামাল মাহমুদ। সেও সবসময় সঙ্গে ছিল। বেসিক্যালি আমাদের কো অ্যাকশন গ্রুপটি আমার নেতৃত্ব বা কোঅর্ডিনেশনে হয়।
সালেক খোকন: আপনাদের সহযোদ্ধা ইকবাল রশিদ এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এ উদ্যোগের লিডার প্রথমে হতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান, আসলে কি তাই?
লিয়াকত আলী খান: সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইকবাল আমার কাছে জানতে চাইল–এই পরিকল্পনার লিডার কে হবেন? তাকে বোঝালাম এটা ক্যু নয়। আমরা কারেকটিভ অ্যাকশনের চিন্তা করছি। শুদ্ধি অভিযান। ওদের ক্যান্টনমেন্টে আনতে হবে। সেখানে জিয়াউর রহমানও আমাদের সাথে থাকবেন। কিন্তু ইকবাল ভাবল এটা ক্যু, এর লিডার করা হয়েছিল জিয়াকে। এটা আসলে ভুল ভাবনা ছিল।
সালেক খোকন: মূল পরিকল্পনাটি কবে হয়?
লিয়াকত আলী খান: অক্টোবরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে হাফিজ আমাকে ধানমন্ডি ৮ নম্বরে সাংগ্রাই রেস্তোরাঁয় আসতে বলেন। গিয়ে দেখি সেখানে খালেদ মোশাররফ, সাফায়াত জামিলসহ আরও দুই-তিনজন আছেন। তাদের সাথে ডিসকাশন হল। খসড়া প্ল্যানও করা হল। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল–এয়ারফোর্সের পার্টিসিপেশন থাকবে কিনা? আমিও কনফিডেন্টলি সম্মতি দিলাম। তখন খালেদ মোশাররফ বললেন–‘শাবাশ’।
সালেক খোকন: তখন জিয়াউর রহমান কি আপনাদের পক্ষে থাকলেন না?
লিয়াকত আলী খান: না। আমরা টের পেয়ে যাই যে, ‘জিয়া ইজ দেয়ার ম্যান।’ কারণ সে তো কিছু করছেই না বরং উল্টো ওদের কথামত বিগ্রেডের অফিসারদের পোস্টিং করে দিচ্ছিল। জিয়াউর রহমান স্বাক্ষর দিয়ে অর্ডারগুলো ওদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তখনই বুঝে যাই জিয়া ইজ নট আওয়ার ম্যান। এ কারণেই পরে সবাই চুজ করছিল খালেদ মোশাররফকে। তাকে নিয়েই চূড়ান্ত পরিকল্পনাটি হয়।
সালেক খোকন: এরপরই কি এয়ারফোর্সের গ্রুপটির প্রস্তুতি নিলেন?
লিয়াকত আলী খান: আমি সবাইকে ডেকে ক্লিয়ার নির্দেশনা দিলাম কে কী করবে। ইকবাল হেলিকপ্টারের দায়িত্ব নিয়ে নিল। সালাউদ্দিন মিগ টোয়েন্টি ওয়ানের। জামাল, জিয়ারত সবাইকেই নির্দেশ দেওয়া হয়।
সালেক খোকন: আপনি তখন কী করলেন?
লিয়াকত আলী খান: এর মধ্যে একদিন বঙ্গভবনে যাই। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, ফারুক ওরা আমার ক্লোজ ছিল। প্রথম দিকে কালো পোশাকপরাদের ওরা বঙ্গভবনের গার্ড করে। আমি আর হাফিজ গিয়ে ওদের বলি, তোমরা ফার্স্ট বেঙ্গলকে এ দায়িত্ব দাও। পরে চিন্তা করে ওরা রাজি হয়।
অক্টোবরের শেষে মেজর ইকবালের নেতৃত্বে ফার্স্ট বেঙ্গলের একটা গ্রুপকে বঙ্গভবনে ঢুকিয়ে দিই। তাদের সাথে ক্যাপ্টেন নজরুল দুই প্লাটুন কমান্ডো নিয়ে বঙ্গভবনে পজিশনে থাকল। এটা ছিল আমাদের পরিকল্পনারই অংশ। ইকবালকে বলেছিলাম কালো পোশাকধারীরা কী করছে আমাদের জানাবা। ভেতরের খবরও দিবা। ওরা কী করছে বা করছে না এটা খবর নিতাম তাদের মাধ্যমে।
তিন চারদিন পরপর আমিও যেতাম। ফলে ওরা ধরেই নিয়েছিল আমি ওদের লোক। এতে আমাদের কাজ করাও সহজ হয়েছিল।
সালেক খোকন: পরিকল্পনা কি তখনও গোপন ছিল?
লিয়াকত আলী খান: না। জানাজানি হয়ে যায় যে একটা মুভ হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে। মেজর ডালিম একবার আমাকে, ইকবাল রশিদ, মেজর হাফিজ এবং মেজর ইকবালকে এক রুমে ধরেছে। নিজেদের ভেতর কথা বলে আমরা প্ল্যান করছিলাম তখন। ডালিম আসতেই সাবজেক্টটা চেইঞ্জ করে ফেলি। কিন্তু এরপর থেকে ডালিম আমাদের সন্দেহের চোখেই দেখত।
সালেক খোকন: এরপর অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিলেন কবে?
লিয়াকত আলী খান: নভেম্বরের ২ তারিখ রাত তখন ১০টা বা ১১টা হবে। হাফিজরা জানায়, পরদিনই অ্যাটাক। আমি ইকবাল রশিদের বাসায় গিয়ে খবরটি জানাই। এয়ারফোর্সে গ্রুপের কমান্ডার হিসেব লিয়াজোঁ রাখি মেজর হাফিজ ও আর্মির গ্রুপটির সঙ্গে।
সালেক খোকন: ৩ নভেম্বর কী ঘটল?
লিয়াকত আলী খান: খুব ভোর তখন, আমি টেন্সড। অ্যাকশনে যেতে হবে। সেনাবাহিনী কি করছিল আমার জানা নেই। সেটা হাফিজ, মুবিন, মিজান, মুনির ওরাই করার কথা। ভোর রাতেই ফোর্থ বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টারে গিয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল ও খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করে ওরা। খবর দিয়েছিল ‘এয়ারফোর্স রেডি’।
কখন টেইক অফ করবে ওরা জানতে চাইলে বলি–ফার্স্ট রাইটেই টেক অব করার কথা। ওরাও নির্দেশ দিয়ে দিল।
বিমান এয়ারলাইনস থেকে কামাল মাহবুব গাড়ি দিয়ে ক্যাটারিং সার্ভিস দিল। সেও আমার সাথে চলে গেল টাওয়ারে। সেখানে থেকেই পাইলটদের ডাইরেকশন দিতে থাকলাম।
সকাল আনুমানিক ৬টা ৩০ মিনিট। দুটো এমআই-এইট হেলিকপ্টার ফুললি আর্মড, উইথ রকেটস অ্যান্ড গানস রেডি টু গো ফর অ্যাকশন। ইকবাল রশিদের সাথে ওঠে স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম বীরউত্তম। পুরো কমিউনিকেশন বন্ধ করে দিয়েছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মিজান। সে ছিল সিগন্যাল অফিসার।
ওরা ফ্লাই করে বঙ্গভবনের দিকে যেতে থাকে। এরপর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালাউদ্দিন ওড়ায় দুটো মিগ।
বঙ্গভবনের ভেতরে তখন মেজর ডালিম ও নূরসহ (এবিএম নূর চৌধুরী) বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। প্রেসিডেন্ট হাউজ ও রেসকোর্সের ওপরে গিয়ে চারবার ট্যাংকগুলোকে গানসাইটে আনে রকেট মারার জন্য। চারবারই তারা কল করে। ফোর্থ বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার থেকে তখন আমাকে টেলিফোনে জানানো হল–‘দে আর রেডি টু সারেন্ডার’। ট্যাংকগুলোও সারেন্ডার করছে। আমি বললাম- ডোন্ট ফায়ার। জামাল আর হেলিকপ্টারগুলো দেখল ট্যাংকগুলো গান ডাউন করে থেমে গেছে। বোঝা গেছে তারা সারেন্ডার করতে চায়।
ইকবাল রশিদ বেশ উত্তেজিত। শেষ করে দেবে সবাইকে। কিন্তু আমি নির্দেশ দিলাম ‘না’। পরে ওরা মন খারাপ করে ল্যান্ড ব্যাক করল।
সালেক খোকন: আপনারা তখন কী করলেন?
লিয়াকত আলী খান: হতাশ হয়ে চলে যাই ফোর্থ বেঙ্গল হেড কোয়ার্টার্সে। সেখানে তখন ছিল বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল, মেজর হাফিজ, কর্নেল মালিকসহ আরও কয়েকজন অফিসার। জেনারেল ওসমানী [মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিত্ব এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন] তখন বঙ্গভবনে। তার মধ্যস্থতায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যে নেগোসিয়েশন চলছিল।
সালেক খোকন: এয়ারপোর্ট কি তখনও আপনাদের নিয়ন্ত্রণে?
লিয়াকত আলী খান: হ্যাঁ, পুরো এয়ারপোর্ট এমওডিসির (মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স কনস্টেবিউলারি) গার্ডদের দিয়ে আমরা ঘিরে রাখি। যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। এমওডিসির ভেতর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল বেশি। ফলে এয়ারপোর্ট তখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সালেক খোকন: তাহলে নির্দেশ না পাওয়ায় আপনারা অ্যাকশনে যেতে পারেননি?
লিয়াকত আলী খান: এয়ারফোর্সে আমরা আমাদের দায়িত্ব শতভাগ পালন করেছি। অ্যাকশনে গেলে ওরা সবাই শেষ হয়ে যেত।
সালেক খোকন: তখনও কি এয়ারপোর্টেই অপেক্ষায় ছিলেন?
লিয়াকত আলী খান: ওইসময় ওখান আসেন উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ (বীরউত্তম) সাহেব [এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ। পরে বিমানবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন, এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারে মন্ত্রীও হয়েছিলেন]।
তিনি বললেন, “যা করেছ তোমরা। এটা কি এয়ার চিফের নলেজে আছে?”
বলি, “তাকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
তিনি বললেন, “তুমি খুঁজলেই পাবা।”
বলেই চলে গেলেন। বুঝলাম, উনি হয়ত চলে গেলেন চিফকে জানাতেই।
তখন চিফকে ধরতে আমি ও ইকবাল যাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কিছু সোলজারসহ।
তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের উত্তর পাশে এয়ারফোর্সের চারটা বাসা ছিল। সেখানে সি টাইপের একটা বাড়িতে থাকতেন ডিজিএফআই এর তৎকালীন চিফ কে এম আমিনুল ইসলাম। তার বাসাতেই পাই এয়ার চিফ তাওয়াবকে (মুহাম্মদ গোলাম তাওয়াব)।
তাকে স্যালুট দিয়ে বলি- “কাম অন উইথ আস স্যার। কমান্ড পোস্টে চলেন।”
চলে যাই ফোর্থ বেঙ্গলে। এসে দেখি সেখানে হৈ চৈ। খালেদ মোশাররফ তর্ক করছেন নেভি চিফের সাথে।
আমরা তাওয়াবকে অন্য একটি রুমে বসাই। অতঃপর খালেদ মোশাররফকে গিয়ে বলি–এয়ার চিফকে আনা হয়েছে।
সালেক খোকন: খালেদ মোশাররফের প্রতিক্রিয়া কী হল?
লিয়াকত আলী খান: ভেবেছিলাম তিনি তাকে অ্যারেস্ট বা গুলি করার কথা বলবেন। কিন্তু রুমে ঢুকতেই তাওয়াব বললেন- “খালেদ হাউ আর ই। ইউ ডান এ গ্রেড জব।”
খালেদ মোশাররফ তো খুব খুশি।
এরপর শুরু হল নেগোসিয়েশন। বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন আসা শুরু হল। বিডিআরের বিগ্রেডিয়ার খলিলুর রহমানও ফোন করতেছেন। জেনারেল ওসমানী ফোন করেন। নেগোসিয়েশন হয় বঙ্গভবন এবং ফোর্থ বেঙ্গলের মাঝে। ফোর্থ বেঙ্গল ছিল এদের কমান্ডপোস্ট। এখানে খালেদ মোশাররফ এবং তাওয়াবসহ আরও অফিসাররা ছিলেন।
সালেক খোকন: নেগোশিয়েশনের বিষয় কী ছিল?
লিয়াকত আলী খান: বেসিক বিষয় ছিল- এখন আর ব্লাডশেড হওয়া উচিত নয়। যা হওয়ার হয়ে গেছে। নো ব্লাডশেড। এদেরকে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত। মূলত এটা ওসামানী সাহেবই বলল। এ প্রস্তাব আস্তে আস্তে ডেভেলপ করল। সিদ্ধান্ত হল, ওদের বাইরে বের করে দেওয়া হবে।
কিন্তু এটা ইয়াং অফিসাররা মেনে নিতে পারছিল না, তারা বেশ আপসেট হয়ে গেল। এদিকে ওইদিন সকালে যে জেলে চার নেতা খুন হন এ খবরটিও আমরা পাই না।
সালেক খোকন: এরপরই কি খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল?
লিয়াকত আলী খান: বিকালে খুনিরা নিজেদের অর্থসম্পদ নিয়ে রেডি হতে থাকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য। তাদের সেইফলি পাঠানোর দায়িত্ব পড়ে এয়ার চিফ তাওয়াবের ওপর।
সালেক খোকন: কেউ কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি?
লিয়াকত আলী খান: না। তবে এয়ারফোর্সের আমরা ছোট একটি পরিকল্পনা করি। কিন্তু সেটি সফল হয় না।
সালেক খোকন: কী পরিকল্পনা?
লিয়াকত আলী খান: দুজন পাইলট ঠিক করে রাখলাম। ওরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ডাইভার্ট করে নিয়ে যাবে সৈয়দপুরে। ওখানে ল্যান্ড করার পরই ওদেরকে ম্যাসাকার করা হবে। এটাই ছিল প্ল্যান। সেখানে মেজর হারুনুর রশীদ রানওয়েসহ সবকিছু রেডি করে রাখেন। পরিকল্পনা মোতাবেক সব হচ্ছিল। কিন্তু কীভাবে যেন তাওয়াব এটা টের পেয়ে যায়। ডালিম, ফারুকসহ খুনিদের নিয়ে ফ্লাই করার ঠিক আগ মুহূর্তে তাওয়াব এসে বলে, ‘ক্রু চেইঞ্জ’।
ক্রু কাকে বসানো হল জানেন? ফারুকের ব্রাদার ইন ল ক্যাপ্টেন আশফাককে। ক্যাপ্টেন ইয়াসমিনের ভাই সে। সাথে আরেকজন ক্যাপ্টেনও ছিল। এভাবেই ৩ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা নিরাপদে ঢাকা থেকে বার্মা হয়ে থাইল্যান্ড চলে যায়।
সালেক খোকন: এরপর কী ঘটল?
লিয়াকত আলী খান: ৪ তারিখ সকালে জানি জেলহত্যার বিষয়টি। সবাই হতাশ হই। ইয়াংরা গালাগালি করল সিনিয়রদের। এরমধ্যে শো ডাউন হল বঙ্গভবনে। কর্নেল শাফায়াত জামিল গেলেন সেখানে। মোশতাক কেবিনেট মিটিং করছিল। সেখানে গিয়ে তাকে সারেন্ডার করায়। বঙ্গভবন আমরা টেকঅভার করে ফেলি।
৫ নভেম্বর সকালে বাশার সাহেব [এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার বীরউত্তম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন, ১৯৭৬ সালে বিমানবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পান। বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির নামকরণ ‘ঘাঁটি বাশার’ তার নামেই] আমাদের স্কোয়াডে এলেন। তখন বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ডেপুটি চিফ তিনি। ডেকে বেশ বাহবা দিলেন। “তোমরা খুব ভাল কাজ করেছ, দেশকে বাঁচিয়েছ, ফোর্সকে বাঁচিয়েছ” বলে ধন্যবাদও দিলেন।
আমাদের ভেতর ভয়ও ছিল। কারণ এয়ারফোর্সে আমরা ওপরের অর্ডারে ৩ নভেম্বরের কাজগুলো করিনি।
৫ নভেম্বরই নতুন প্রেসিডেন্ট সিলেকশন হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাজি হলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার অভিষেক হয়। এরপর খালেদ মোশাররফকে প্রমোশন দিয়ে ব্রিগেডিয়ার করা হয়। তাকে র্যাংক ব্যাজ পরালেন এয়ার চিফ তাওয়াব ও নেভি চিফ এমএইচ খান।
সালেক খোকন: খালেদ মোশাররফ এরপর কী করছিলেন?
লিয়াকত আলী খান: ৬ নভেম্বর আমরা দেখলাম কিছু এগোচ্ছে না। ওইদিন স্টেডিয়ামে একটা খেলা ছিল। আবহানী আর মোহামেডানের। ওখানে লিফলেট ছড়ানো হয়। আমি তখন বঙ্গভবনে, এমএসপিতে অফিস করছি। প্রেসিডেন্টের অফিসের পাশেই। ওই লিফলেট নিয়ে বিকেলে ডিজিএফআইয়ের ইসলাম সাহেব হন্দদন্ত হয়ে ঢুকলেন। সিচুয়েশন বেশ টাফ যাচ্ছে, এটা আমার রিপোর্ট। চিফকে জানিয়ে দাও।
আমি দেখলাম এটা জাসদের উসকানিমূলক লিফলেট। সেগুলো নিয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল স্যারকে পৌঁছে দিলাম। উনি বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দিলেন না। লাইটলি বললেন, “চিন্তা করার কিছু নেই। এগুলো একটু হবেই।”
সালেক খোকন: মার্শাল লর পরিকল্পনা তখনই হয়?
লিয়াকত আলী খান: পরিকল্পনা হয় মার্শাল ল এ সাইন করার। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। তখন ঘাপলা বাধল। কী বিষয়? খালেদ মোশাররফ সাইন করবেন না। কারণ তিনি চাচ্ছেন, হি শুড কাম ডিএমএলএ অ্যান্ড দা আদার শুড বি এএমএলএ। সিএমএলএ তো বিচারপতি সাঈম সাহেব থাকবেনই। কারণ হি ওয়ান্টস আ ইফেক্টিভ রোল। কিন্তু এয়ারচিফ তাওয়াব চাচ্ছিল না এটা। সে চাচ্ছে “উই শুড বি থ্রি ইকুয়াল”।
আমি তখন শাফায়াত জামিলকে বললাম, স্যার, এটায় তিনজনকে লেভেলে একই থাকতে দেন। আর্মি চিফ উইল ইন কমান্ড এভরিওয়ে। এ মুহূর্তে ডিভাইডেশন উচিত হবে না। শাফায়াত জামিলও তাই বললেন।
কিন্তু রাত ১০টা পর্যন্ত সেটা সাইন হল না। রাত পৌনে ১১টার দিকে শাফায়াত এসে বললেন খালেদ মোশাররফ রাজি হয়েছেন। তুমি দুই চিফকে আনার ব্যবস্থা কর।
বাশার সাহেবকে ফোন করলাম। উনি বললেন এমএইচকে ফোন কর। উনি নেভি চিফ। তার বাসায় এয়ারচিফও আছেন। টেলিফোনে কথা বলতেই পনের মিনিটের ভেতর তারা চলে আসেন বঙ্গভবনে।
কিন্তু খালেদ মোশাররফ একটা রুমে ঢুকে তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক কোনো কথা না বলেই চলে গেলেন প্রেসিডেন্টের রুমে। দুই চিফ বেশ অপমানিত বোধ করলেন। সাইন হল না। তাদের কাছে ক্ষমা চাইলাম। তারা বললেন, সকালে এসে আমরা সাইন করে দেব। তখন মার্শাল ল ডিক্লেয়ার করে দেওয়া যাবে।
সালেক খোকন: এরপর?
লিয়াকত আলী খান: আমি তখন হতাশা । একজনের পরামর্শে মেজর হাফিজকে ফোন করে বললাম–দুই চিফ এসেছিল তবুও খালেদ মোশাররফ সাইন করছে না। তুমি আসো।
সে কথা বলছে তখনই ওপাশে গোলমালের শব্দ। সে বলল, এখানে গুলির শব্দ হচ্ছে। আমি দেখে তোমাকে ফোন করছি। এরপর আমি আর হাফিজের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। সে ছিল ক্যান্টনমেন্টে বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে।
পরে চলে আসি এমএসপির রুমে। এসে দেখি খালেদ মোশাররফ আর হুদা দুটি টেলিফোনে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছেন। বুঝে যাই সিচুয়েশন আউট অব কন্ট্রোল। তাদের বললাম, স্যার আমি দেখে আসি এয়ারফোর্স ঠিকঠাক আছে কিনা। বলেই বেরিয়ে যাই।
ওয়ালিকে প্রথম ফোন করলাম। সে বলল-এয়ারফোর্সে সব ঠিকই আছে।
আমি তখন গাড়ি ঘুরিয়ে বঙ্গভবনের দিকে গেলাম। খালেদ মোশাররফরা তিনটা গাড়ি রেডি করছে, বঙ্গভবন ত্যাগ করবে। জানতে চাইলে বলেন-কমান্ড পোস্টে যাচ্ছি। তুমিও আস।
ওদের গাড়ির পেছনে আমি। প্রথম গাড়িটাতে এমপিআর দ্বিতীয় গাড়িটা ল্যান্ডক্রুজার। তাতে ওদের তিনজন অফিসার- হুদা, হায়দার আর খালেদ মোশাররফ। লাস্ট কালো গাড়িটা খালি। আমি তাদের গাড়ি ফলো করছি।
উনারা ইউনিভার্সিটি ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশ দিয়ে এগোন। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে মিরপুর রোড দিয়ে যেতে থাকেন। ধানমন্ডি দুই নম্বর দিয়ে আসাদ গেটের সামনে গিয়েই থামেন।
আমি কনফিউজড! ওরা কী করতে চাচ্ছে? ওরা যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এটা বেশ বুঝতে পারলাম।
গাড়ি ঘুরিয়ে তারা আবার নিউ মার্কেটের দিকে এগোয়। আমার গাড়ির তেল তখন শেষ। ফলে আমি গাড়ি নিয়ে ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে এক মামার বাড়ি চলে এলাম।
সালেক খোকন: ৭ নভেম্বর এল, কী ঘটেছিল ক্যান্টনমেন্টে?
লিয়াকত আলী খান: ওইদিন ক্যান্টনমেন্টে ফায়ারিং শুরু করে কর্নেল তাহেরের (কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম) গ্রুপ। ওই দিনই গুলি করে মেরে ফেলা হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার ও কর্নেল কে এন হুদাকে। তাওয়াব সাহেব তখন তুঙ্গে। কারণ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তিনি হাত মিলিয়েছেন।
সালেক খোকন: অ্যারেস্ট হলেন কীভাবে?
লিয়াকত আলী খান: ৭-৮ দিন পর খবর আসে, এয়ার চিফ তাওয়াব সাহেব কথা বলতে চান। প্রথমে অফিসারদের স্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানান পদ্মা গেস্ট হাউজে। তাদের উপস্থিতিতেই আমাদের ডেকে নিয়ে অ্যারেস্ট করেন কোর্ট মার্শালের জন্য।
সালেক খোকন: কোর্ট মার্শালের দায়িত্বে ছিলেন কারা?
লিয়াকত আলী খান: ৫ জন জাজ ছিলেন, সবাই রিপ্যাট্রিয়েটেড (পাকিস্তান ফেরত) অফিসার। হামিদুর রহমান, সাইফুল আজম, হাবিবুর রহমান– এরা ছিলেন জাজ। আমরা এটাকে বলি ক্যাঙ্গারু কোর্ট। সিদ্ধান্ত হয়েই আছে, শুধু আমাদের ওরা সাজা শোনাবে।
সালেক খোকন: কী শাস্তি দেওয়া হল আপনাদের?
লিয়াকত আলী খান: প্রথমে ট্রায়াল হয়। আমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। ইকবাল রশিদ ও বদরুল আলম বীর উত্তমকে যাবজ্জীবন, বাকিদের ৫ বছর, দুই বছর, এক বছর করে জেল হয়। এরপরই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা জেলে, সেল নম্বর ০১।
সালেক খোকন: পরে ছাড়া পেলেন কীভাবে?
লিয়াকত আলী খান: জিয়াউর রহমান কোনো এক কারণে তাওয়াবকে দেশ থেকে বের করে দিলে এয়ার চিফ হন মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার সাহেব। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ফলে ১৯৭৬ সালের মে মাসের দিকে আমাদের জেল থেকে বের করে আনেন ।
সালেক খোকন: ৩ নভেম্বর ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
লিয়াকত আলী খান: ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ শুধু সময়ক্ষেপণ করেছেন। এয়ারফোর্স, আর্মি ও নেভী তার হাতের মুঠোয় থাকলেও এর বাইরেও যে কেউ তাকে সরাতে পারে, এটা তার ধারণায় ছিল না। এছাড়া ওইসময় তার মাইন্ড ছিল আনস্টেবল। তিনি কি মার্শাল ল ডিক্লেয়ার করতে সত্যি চেয়েছেন? না হলে কেন তিনি ওই রেসপনসিবিলিটি নিলেন? কেন তিনদিন রেডিও বন্ধ রাখা হয়েছিল? খালেদ মোশাররফ কেন কিছুই ডিক্লেয়ার করলেন না বরং নিজের জীবনটাও নষ্ট করলেন। হুদা ও হায়দারের মত অফিসার তার সঙ্গে থাকার কারণেই নিহত হলেন।
সালেক খোকন: পরে আপনারা চাকরির বেনিফিট কি পেয়েছিলেন?
লিয়াকত আলী খান: এখনও পাইনি। প্রথমে আমাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালে। পরে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সার্ভিস কন্টিনিউ করা হয়। সে হিসেবে পুরো পেনশন বেনিফিট আমরা পাই। কিন্তু এর পরে একটা চিঠি জারি করা হয়, যেখানে লেখা ছিল কোনো বেনিফিট আমরা পাব না। ফলে কোনো পেনশন বা বেনিফিট আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি। আমি মনে করি, আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে এবং এখনও তা বলবৎ আছে।
সালেক খোকন: ৩ নভেম্বরে সেনাবাহিনীর যারা (অভ্যুত্থানচেষ্টায়) যুক্ত ছিলেন, চাকরিতে তাদেরও কি একই অবস্থা হয়েছে?
লিয়াকত আলী খান: না। সেনাবিহনীতে যারা ৩ নভেম্বরে যুক্ত ছিল, তারা মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিল। ওইদিন যদি এয়ারফোর্স মুভ না করত, আর্মি অগ্রসর হতে পারত না। তাদের ফাইট করার ক্ষমতাও ছিল না। অথচ দেখেন এ ঘটনার পরও আর্মির সবাই পেনশন পাচ্ছে। এয়ারফোর্সের কেউ পাচ্ছি না। তাদের (আর্মি) শাস্তিও হয় নাই। হয়েছে শুধুই এয়ারফোর্সের সদস্যদের। কেন এই বৈষম্যটি থাকল?
সালেক খোকন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
লিয়াকত আলী খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।