Image description

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনার জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিদ্যুৎ খাতের বেশিরভাগ চুক্তিতে বেসরকারি কোম্পানি, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আমলাদের একটি চক্রের যোগসাজশ ছিল।

সেই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রীও ছিলেন। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিতে বারবার হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

কমিটি ভারতের আদানি পাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিতেও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে এবং এ বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের সহযোগিতা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।

গতকাল রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে কমিটির প্রতিনিধিরা প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে। 

জাতীয় কমিটির প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, তারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারদের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি, যোগসাজশ, প্রতারণা, অনিয়ম এবং বেআইনি কার্যকলাপ খুঁজে পেয়েছেন।

কমিটি কিংবা সরকার কোনো পক্ষই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি। এটি কমিটির "অন্তর্বতীকালীন গোপনীয় প্রতিবেদন" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, এর সংবেদনশীলতা যাচাই করে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কমিটিও প্রতিবেদনটি উন্মুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে। এছাড়াও তারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) এবং বাস্তবায়ন চুক্তিগুলো (আইএ) জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে।

দ্য ডেইলি স্টার কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলছেন, তারা চুক্তিগুলোকে ব্যবসায়ের জন্য 'ঝুঁকিশূন্য' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, বিশ্বের কোনো ব্যবসায় ঝুঁকিমুক্ত নয়, তবে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা যেকোনো বিনিয়োগকারীর জন্য উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করেছে।
 
কমিটির আরেক সদস্য বলেন, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আমলাদের মধ্যে যোগসাজশ ছিল।

"একবার ভাবুন কেন বিদ্যুৎ বিভাগ সবসময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। চুক্তিগুলো সইয়ের পেছনে তাদের প্রভাব ছিল" বলে তিনি উল্লেখ করেন।

প্রতিবেদনে কমপক্ষে সাবেক দুই বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা পরে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব হন।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এমন চুক্তিগুলো স্বাক্ষরেরর জন্য একটি 'তদারকি ব্যবস্থা' তৈরির সুপারিশ করেছেন তারা। একইসঙ্গে বর্তমানে চলমান চুক্তিগুলো, যারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলে কমিটি চিহ্নিত করেছে, তাদের সঙ্গে পুনরায় দাম নির্ধারণে দরকষাকষির সুপারিশ করেছে।

'আমরা এরইমধ্যে চুক্তিগুলো সই করেছি এবং এর মধ্যে আটকা পড়েছি। চুক্তিগুলোতে পুনরায় দরকষাকষি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই,' তিনি আরও বলেন।

কমিটি 'আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির প্রক্রিয়াগত অনিয়ম' নিয়ে আরেকটি সম্পূরক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে চুক্তি সইয়ের সময় 'প্রক্রিয়াগত ত্রুটি' থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটির এক সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা দেখেছেন চুক্তির খসড়াটি আদানি পাওয়ার নিজেই তৈরি করেছিল। এতে সই করতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, চুক্তি বাতিলের জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, যা প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে।

তিনি বলেন, 'কোনো কারণ ছাড়া যদি আমরা চুক্তি বাতিল করি, তাহলে কোম্পানিগুলোকে বড় পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই, আমাদের সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে চুক্তি বাতিল করতে হবে। এবং সেই সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দুর্নীতি। কারণ বেশির ভাগ চুক্তিতেই একটি অনুচ্ছেদ থাকে, যেখানে উভয় পক্ষের একটি স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি... যদি আমরা চুক্তিতে দুর্নীতি খুঁজে পাই, তা হলে তা বাতিল করতে দ্বিধা করব না।'

উচ্চ আদালতে আদানির বিদ্যুৎ কেনা নিনিয়ে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ দুর্নীতির প্রমাণ সংগ্রহে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত এই কমিটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিতে প্রায় ১৪ মাস সময় নিয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে কার্যক্রম শেষ হবে বলে তারা আশা করছে।

কমিটির প্রধান বলেন, কমিটিকে ২০১০ সালের 'কুইক এনহ্যান্সমেন্ট অব ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই (স্পেশাল প্রোভিশন) অ্যাক্ট' (বর্তমানে বাতিল) এর আওতায় স্বাক্ষরিত বেশিরভাগ বিদ্যুৎ চুক্তির অনেক নথি, প্রক্রিয়াগত কাগজপত্র, অর্থ পরিশোধের বিবরণ এবং উৎপাদন তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। এতে দীর্ঘ সময় লেগেছে।