Image description

উচ্চ বেতনে কাজের প্রলোভনে দুবাই যান এক তরুণী। সেখানে একটি ক্লাবে নিয়ে তাকে স্টেজ শো ও অতিথিদের সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন কাজে বাধ্য করা হয়। প্রতিবাদ করলে খাবার বন্ধ করে নির্যাতন চালানো হতো। এমনকি চুক্তি অনুযায়ী টাকাও দেওয়া হতো না। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরত আসেন ওই তরুণী।

ওই তরুণীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২ জুলাই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার মৃণাল কান্তি শাহ রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত শেষ করে সম্প্রতি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি। প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী ওই তরুণীসহ আরও দুই ভুক্তভোগী তরুণীর জবানবন্দি রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে তরুণীদের ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই পাঠানো হতো। এরপর তাদের জোরপূর্বক নাচ করতে বাধ্য করা হতো। পরে ড্যান্স ক্লাবের অতিথিরা যৌন নিপীড়ন করতো। - সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মামলার প্রধান আসামিদের দুবাইয়ে ব্যবসা রয়েছে। দেশে অন্য সহযোগীদের সহায়তায় তারা একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র পরিচালনা করছিল। তারা বাংলাদেশ থেকে তরুণীদের ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠাতো। তবে ভ্রমণের পর তাদের জোরপূর্বক নাচে বাধ্য করা হতো এবং ক্লাবে উপস্থিত অতিথিদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নে বাধ্য করা হতো।

১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

তদন্তে মানবপাচারের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে ১৪ জনের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ছয়টি ধারায় অভিযোগ এনে আদালতে অভিযোগপত্রটি জমা দিয়েছে সিআইডি।

 

অভিযুক্ত ১৪ জন হলেন আল-আমিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড (২৬), মো. স্বপন হোসেন (২৮), মো. আজম (৪৫), মো. নাজিম উদ্দিন (৩৬), মো. এরশাদ (৩৭), নির্মল চন্দ্র দাস (৩৮), মো. আলমগীর (৪২), আব্দুল কুদ্দুস ওরফে হৃদয় আহম্মদ (৩৫), আনোয়ার হোসেন ওরফে ময়না (৫৬), মো. ইয়াসিন (৩৩), মো. অনিক হোসেন (৩৭), গৌতম সাহা (৫৩), মো. আক্তার হোসেন (৪০) এবং মো. শাহাব উদ্দিন (৪২)।

পুলিশ জানিয়েছে, এজাহারভুক্ত এক আসামি নিজেকে নৃত্য প্রশিক্ষক পরিচয় দিয়ে তার পরিচিত এক নারীর মাধ্যমে ওই তরুণীকে নাচ শিখিয়ে বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেন। ওই তরুণীকে প্রতারণার মাধ্যমে অন্য এক আসামির কাছে দেওয়া হয়। পরে তরুণীকে দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাবে এক ব্যক্তির কাছে নেওয়া হয়। সেখানে মৌখিকভাবে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতন ও থাকা-খাওয়ার সুবিধার আশ্বাস দেওয়ার ভিত্তিতে পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়। পরে ২০১৯ সালের মে মাসে তাকে শারজাহ পাঠানো হয়। পৌঁছানোর পর তাকে জোরপূর্বক আটকে রেখে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা একাধিকবার যৌন নির্যাতন চালান। চুক্তি অনুযায়ী বেতনও দেওয়া হয়নি।

 

একই পদ্ধতিতে চক্রটি বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতারণার মাধ্যমে একাধিক তরুণীকে সংগ্রহ করে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করে। আটক রেখে যৌন শোষণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এ অপরাধ চালিয়ে আসছে। - পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন

অভিযোগে আরও জানা যায়, একই পদ্ধতিতে ওই চক্র বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতারণার মাধ্যমে একাধিক তরুণীকে সংগ্রহ করে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে পাচার করে এবং আটক রেখে যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। তদন্তে তাদের একটি সংঘবদ্ধ ও সু-সংগঠিত মানবপাচারকারী চক্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; যারা দীর্ঘদিন ধরে এ অপরাধ চালিয়ে আসছেন।

প্রাথমিক তদন্তভার পেয়ে লালবাগ থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ঘটনাস্থল পরিদর্শন, খসড়া মানচিত্র প্রস্তুত ও বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে মতামত দেন। পরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর হওয়ায় এসআই মো. কামরুজ্জামান তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি আগের তদন্ত পর্যালোচনা করে পুনরায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ভুক্তভোগী তিনজনের ১৬১ ও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করান।

পাশাপাশি এজাহারভুক্ত ছয়জন আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এর মধ্যে চারজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এক আসামির হেফাজত থেকে ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পলাতক আসামিদের শনাক্তকরণে সিডিআর সংগ্রহ, ঠিকানা যাচাই এবং তদন্ত অব্যাহত রাখা হয়। ভুক্তভোগীদের বিদেশ যাত্রা ও দেশে প্রত্যাবর্তনের তথ্যও সংগ্রহ করে সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া মূল আসামির বিদেশগমন নিষিদ্ধ করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়।

তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা শেষে সিআইডি বলছে, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বাংলাদেশি নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার এবং বাধ্যতামূলক যৌন শোষণ করে আসছেন। তদন্ত শেষে সিআইডি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

‘করোনা পরিস্থিতিতে ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও জবরদস্তি চলতে থাকে এবং খাবার সীমিত করে হয়রানি করা হয়। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় ২০২০ সালের ১৬ জুন দেশে ফেরত আসি।’ - ভুক্তভোগীর জবানবন্দি

মামলায় জবানবন্দিতে আরেক ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, আসামি সিমির মাধ্যমে নির্মল দাস তাকে দুবাইয়ে হোটেলে কাজের প্রলোভন দেন। পরে নির্মল ও নাজিম তার পাসপোর্ট এবং ভিসার ব্যবস্থা করে ২০১৯ সালের ২৩-২৪ ডিসেম্বর তাকে দুবাই পাঠান। দুবাই পৌঁছে আরেক আসামি আজমের লোকজন তাকে সিটি টাওয়ার হোটেলে রেখে স্টেজ শো ও অতিথিদের সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন কাজে বাধ্য করে। বেতন না দিয়ে বিভিন্ন সময় নির্যাতন ও আটক রাখা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও জবরদস্তি চলতে থাকে এবং খাবার সীমিত করে হয়রানি করা হয়। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় তিনি ২০২০ সালের ১৬ জুন দেশে ফেরত আসেন। তিনিও সংশ্লিষ্টদের মানবপাচারের জন্য বিচার দাবি করেন।

আরেক ভুক্তভোগী জানান, ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দুবাই পাঠানো হয়। প্রতিবেশী লাইজুর মাধ্যমে ফাতেমার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তার মাধ্যমে আল-আমিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ডের কাছে ৪০ হাজার টাকা দেন। ডায়মন্ড পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট করে ২০১৯ সালের ২৪ মে দুবাই পাঠায়। সেখানে আজম, নাজিম ও এরশাদ তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে হোটেলে স্টেজে যেতে বাধ্য করেন। অতিথি পছন্দ করলে আলাদা রুমে পাঠানো হতো, অমান্য করলেই নির্যাতন চলত। কোনো টাকা দেওয়া হতো না। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় ২০২০ সালের ১৬ জুন দেশে ফেরেন।

ভুক্তভোগী বলেন, ‘মানবপাচারকারী এই চক্রের কঠোর শাস্তি চাই যেন আর কোনো মেয়েকে এমন নির্যাতনের শিকার হতে না হয়।’

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভানসহ ২৩ জনকে অব্যাহতি

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের আলোচিত মামলা থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগসহ মোট ২৩ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সিআইডি।

আসামি ইভান শাহরিয়ারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ফরেনসিক পরীক্ষায় মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডিভাইসগুলোতে থাকা তরুণীদের পাসপোর্ট নম্বর যাচাই করে দেখা যায়, তারা দেশ–বিদেশে নাচের শোতে অংশ নিতে পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। - তদন্ত কর্মকর্তা

তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, ইভান শাহরিয়ারসহ ২৩ আসামির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি, তাই তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামি ইভান শাহরিয়ারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ফরেনসিক পরীক্ষায় মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডিভাইসগুলোতে থাকা তরুণীদের পাসপোর্ট নম্বর যাচাই করে দেখা যায়, তারা দেশ–বিদেশের নাচের শোতে অংশ নিতে এবং একটি সামরিক অনুষ্ঠানের প্রবেশকার্ড তৈরির জন্য পাসপোর্টের কপি দিয়েছিলেন।

পুলিশ জানায়, ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার নিকেতন এলাকা থেকে ইভানকে গ্রেফতার করেছিল সিআইডি। দুবাই পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা আজম খানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের পর তার নাম আসে। ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর আদালত তাকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠান।

চলচ্চিত্র ‘ধ্যাততেরিকি’-তে নৃত্য পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ইভান শাহরিয়ার দীর্ঘদিন ধরে স্টেজ ও করপোরেট শো পরিচালনা করে আসছেন।