 
              ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের করা বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত চুক্তিতে ঘুষ লেনদেনসহ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ জন্য সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি।
দুদকের উপপরিচালক আল আমিনকে এ কমিটির দলনেতা করা হয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম আমাদের সময়কে কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কমকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তিটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান পরিচালনা করবে নতুন কমিটি। তারা চুক্তির মূল কাঠামো, আর্থিক ফিজিবিলিটি, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিসহ সব দিক থেকেই বিস্তারিত পর্যালোচনা করবে। এই কমিটিতে তিনজন সদস্য আছেন, যাঁদের সবারই প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ও পেশাগত দক্ষতা রয়েছে।
এর আগে এ বিষয়ে দুদকের আরেকটি অনুসন্ধান কমিটি কাজ করেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন এই কমিটি আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা চুক্তির বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এবং এখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না দেখবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ দিন। যাচাই-বাছাই শেষে যদি দেখা যায় চুক্তিটি বৈধ নয় বা অযৌক্তিক, তাহলে আদানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের বিষয়ে কমিটি তাদের সুপারিশ দেবে।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাশ কাটিয়ে শুল্ক ও কর অব্যাহতির মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ফাঁকির একটি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। সেই অভিযোগসহ সব অভিযোগ অনুসন্ধানে নতুন কমিটি গঠন করল দুদক।
এর আগে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের শুল্ক ফাঁকির তদন্তে নেমে প্রমাণ পায় এনবিআর। আলোচিত এ চুক্তির সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে শুল্ক ও কর অব্যাহতি দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে সংস্থাটির তদন্তে।
এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দল তদন্তে নেমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অংশ হিসেবে কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিলের প্রমাণ পায়নি। এ ছাড়া তা আইনি পন্থায় নিষ্পত্তি না করার প্রমাণও পায়। এর প্রেক্ষাপটে কর ফাঁকির বিপুল এ অর্থ পিডিবির কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করে এনবিআরের ওই তদন্ত কমিটি।
আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার আলোচিত এ চুক্তিতে শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না, এমন আরও কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্তে নেমেছিল এনবিআরের আট কর্মকর্তার তদন্ত দল।
তাদের প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য উঠে আসে।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি। এনবিআরের দল তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় আদানি গ্রুপ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক ও অব্যাহতি দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে এনবিআরসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, চুক্তিতে আদানিকে দেশের অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই সুবিধার কারণে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবেই বছরে আদানি অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়ে যাবে। ওই চুক্তি নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিটি করে বাংলাদেশ। গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে আমদানি করা কয়লার বেশি দাম দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে উৎপাদনে যাওয়া ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার এক দশমাংশ পূরণ করে।
চুক্তির আওতায় গেল বছর জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে ১০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ; যার মূল্য ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার। এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা এনবিআরের। চুক্তিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভাষায় এটি ‘ফাঁকি’।
আমদানি করা বিদ্যুতের শুল্ক-কর মওকুফ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল কি না এবং থাকলে এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দাকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড লিখিত জবাব দেয়। সেখানে বলা হয়, আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিভাগ ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আদানির বিদ্যুতের ওপর থেকে প্রযোজ্য যাবতীয় শুল্ক ও কর মওকুফের আবেদন করে।
আদানির সঙ্গে করা চুক্তির ৪.৩ দফা অনুযায়ী কিছু শর্ত লঙ্ঘন হলে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থতা, কয়লার দাম ও ওজনে কারচুপি করা ইত্যাদি। চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো রকম ঘুষ বা আর্থিক লেনদেন প্রমাণ করতে পারলেও চুক্তি বাতিল করা যাবে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কোনো অনিবার্য পরিস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশ চুক্তি বাতিল করতে পারবে।
চুক্তি বাতিলের আরেকটি শর্তে রয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যদি কোনো আইনের পরিবর্তনের কারণে আদানির বিদ্যুতের দাম দিতে আইনি সংকট তৈরি হয়, তাহলে এই চুক্তি বাতিল হবে। চুক্তি অনুযায়ী, আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের কম বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। এর কম নিলেও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লার দাম বাংলাদেশকে দিতে হবে। এর সঙ্গে কয়লা পরিবহনের জাহাজভাড়া, বন্দরে ব্যয় ও পরে কয়লা পরিবহনের অর্থও দিতে হবে।
 
       
                 
                
 
                                                  
                                                  
                                                  
                                                  
                                                 