‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির কাছে বিপুল সংখ্যক আসামির জামিন দেওয়ার ঘটনায় ব্যাখ্যা চেয়েছেন প্রধান বিচারপতি।’ গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশের পর থেকে আদালত অঙ্গনে বিষয়টি দিনভর আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এতে সংক্ষুব্ধ হন বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। এমন ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ সভাও ডেকেছে আইনজীবী সমাজ। তবে আলোচনার উত্তাপ কমাতে রাতেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রধান বিচারপতির অবস্থান সম্পর্কে অবগত করেছে কোর্ট প্রশাসন।
এদিন সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়, ‘বিভিন্ন মামলায় বিপুল সংখ্যক জামিন দেওয়ার ঘটনায় তিন বিচারপতির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ব্যাখ্যা চাওয়া হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতি হলেন— বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।’
ওই সংবাদ প্রচারের পর থেকেই সংক্ষুব্ধ হতে শুরু করেন সুপ্রিম কোর্টে আসা বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা।
হাইকোর্টে জামিন নিতে আসা বিচারপ্রার্থী আরাফাত রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আজকে (মঙ্গলবার) একটি কোর্টে আমার ছেলের জামিন-বিষয়ক মামলা শুনানির জন্য ছিল। গত সপ্তাহেও এ মামলার অন্য আসামিরা জামিন পেয়েছেন। আজ দুপুরে এ মামলার শুনানি হয়েছে। সকালে বিচারপতিদের কাছে ব্যাখ্যা তলবের খবর প্রকাশের পর আদালতগুলো কেমন যেন জামিন দিতে চাইছে না, বলে আমার মনে হলো। দুপুরে আমার মামলার শুনানি হলেও ছেলেটার জামিন মিললো না। রাজনৈতিক মামলায় আমার ছেলেকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে জেলে পাঠানো হয়েছিল। অধস্তন আদালতে জামিন না পেয়ে হাইকোর্টে এসেছিলাম। এত বড় আদালতেও ন্যায়বিচার না পেলে আমরা বিচারপ্রার্থীরা কোথায় যাবো।’’
জানা গেছে, গত ২৩ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে হাইকোর্টের জামিন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেদিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের উপস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়— সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ একদিনে ৮০০ মামলায় জামিন দিয়েছে। একটি বেঞ্চে একদিনে এত মামলার শুনানি কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনায় প্রশ্ন উঠে।
আইনজীবীরা মনে করছেন, আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের রেশ ধরেই হাইকোর্টের তিন বিচারপতির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এবং ফোন করেন ওই তিনজন বিচারপতিকে— ‘প্রধান বিচারপতি স্যার, খুব শিগগিরই আপনার সঙ্গে পৃথকভাবে দেখা করবেন। কিন্তু, বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে স্যার (অবশ্যই ২৮ অক্টোবরের মধ্যে) লিখিত (বিস্তারিত এবং মামলা-নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা) চান, যাতে আপনার এত জামিন আবেদনের বিবরণ থাকে। প্রধান বিচারপতি স্যার এমন প্রতিবেদনের অনুরোধ করেছেন, যাতে অবশ্যই এই জামিন আবেদনকারীদের আইনজীবীদের বিবরণ থাকতে হবে।’
হাইকোর্টের তিন বিচারপতির কাছে এমন ব্যাখ্যা চাওয়ার ঘটনার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী মোস্তাফিজুর রহমান আহাদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “The Hon’ble the Chief Justice of Bangladesh and His Companion Judges of the Supreme Court of Bangladesh. মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় যদি এই কথাটির অর্থ বুঝতেন, তাহলে এই ব্যাখ্যা চাইতেন না। উনি মূলত নিজেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অথচ ওনার ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত ছিল— আইন উপদেষ্টার কাছে। আমার মনে হয়, মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং আইন উপদেষ্টার নতুন করে ক্রিমিনাল জুরিপ্রুডেন্স পড়া উচিত। মাননীয় প্রধান বিচারপতি দীর্ঘদিন ইংরেজি ভোকাবুলারি এবং কোম্পানি বেঞ্চ নিয়ে ব্যস্ত থেকে বর্তমানে আসিফ নজরুলের ফুটবল খেলার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। মেধাবী মানুষ, আশা করি, ক্রিমিনাল জুরিপ্রুডেন্স একটু রিভিশন দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
বুধবার প্রতিবাদ সভা ডেকেছেন আইনজীবীরা
হাইকোর্টের তিন বিচারপতির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার ঘটনায় বুধবার (২৯ অক্টোবর) দুপুর ১টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে প্রতিবাদ সভা ডেকেছেন আইনজীবীরা। এ বিষয়ে সমিতির সদস্যদের পক্ষে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. আশরাফুল ইসলাম।
বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘‘এই শরৎকালীন অবকাশের সময় এবং জুলাই-আগষ্ট-২০২৫ মাসে বারের সিনিয়র ও নিয়মিত প্রাকটিসরত বারের সদস্যদের আবেদনের বিভিন্ন ফৌজদারি বেঞ্চগুলো অনেক সময় নির্ধারিত সময়সীমার পরেও শুধুমাত্র আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন মোশন শুনেছেন। মাননীয় হাইকোর্ট ডিভিশনের এই বেঞ্চগুলো ‘এজাহারভূক্ত/এজাহার বহির্ভূত আসামি’ এই রকম বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে শুধুমাত্র আসামিপক্ষের আইনজীবীদের নয়, রাষ্ট্রপক্ষের ডিএজি, এএজিদের শুনানি সমাপ্তির পর মোশনগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করেছেন, যেখানে রাষ্ট্রেরপক্ষে আইন কর্মকর্তারা মোশনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করেছেন, যার কারণে বারের সদস্যরা এই বেঞ্চগুলো ও আইন কর্মকর্তারাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাছাড়া গত ৩৫-৪০ বছর ধরে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিভিন্ন বেঞ্চ বিভিন্ন সময় নিরাপরাধ সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের নিশ্চিতের স্বার্থে এরকম কার্যক্রম সচরাচর করে আসছেন, যে কারণে অতীতে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকার হাইকোর্ট ডিভিশনের বিভিন্ন বেঞ্চের সমালোচনা করেছেন।’’
‘‘কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে, শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও হাজার হাজার পঙ্গু ও দৃষ্টিশক্তি হারানো নাগরিকদের রক্ত, ঘামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের জামিন প্রদান প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ফ্যাসিষ্ট সরকারের আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বার সত্তর ও আশির দশকে এবং সবসময়ই সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও নির্বাহী বিভাগের যেকোনও অন্যায় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আইন উপদেষ্টার এই অনভিপ্রেত, দুঃখজনক বক্তব্য মাননীয় হাইকোর্ট ডিভিশন তথা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি চূড়ান্ত হস্তক্ষেপের শামিল। এই ধরনের বক্তব্য আমরা অতীতে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকারের কাছ থেকে শুনেছি। কারণ তাদের স্বৈরাচারী কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার জন্য সবসময় বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টার মুখে বিচার বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে এই ধরনের বক্তব্য শুধু দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনকই নয় বরং বিচার বিভাগের যতটুকু স্বাধীনতা আছে, তাও খর্ব করার শামিল।’’
আইনজীবীদের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি তার বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। যেকোনও শ্রদ্ধেয় বিচারপতির বিচারিক কার্যক্রমে কোনও আপত্তি/অভিযোগ উত্থাপিত হলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সেই বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের কোনও বিচারপতির বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ সংবিধান ও আইনসম্মত নয় বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ভঙ্গুর ও দুর্বল করে।’’
প্রধান বিচারপতির অবস্থান স্পষ্ট করলো কোর্ট প্রশাসন
দিনভর আলোচনা-সমালোচনার পর বিষয়টি সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘আজ (২৮ অক্টোবর) কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিপুল সংখ্যক জামিন প্রদান করায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন মাননীয় বিচারপতি মহোদয়কে শোকজ করে তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ মহোদয়। সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এবং ফোন করে তিন জন বিচারপতি যথা- মাননীয় বিচারপতি আবু তাহের সাইফুর রহমান, মাননীয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও মাননীয় বিচারপতি জাকির হোসেন মহোদয়কে এই নোটিশ সম্পর্কে অবহিত করেছেন।’’
‘‘বাস্তবে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ মহোদয় উল্লিখিত তিন জন মাননীয় বিচারপতি মহোদয়কে কোনও শোকজ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেননি। বরং প্রশাসনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কেবলমাত্র মামলা সংক্রান্ত কিছু তথ্য চেয়েছেন, যা আদালত ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার একটি নিয়মিত দাফতরিক বিষয়।’’
‘‘সুতরাং, উক্ত সংবাদে ব্যবহৃত তথ্যে মূল বিষয়টি বিকৃত ও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, উক্ত বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপনীয় একটি যোগাযোগ।’’
‘‘এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা হচ্ছে— প্রতিটি গণমাধ্যম আদালত সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের আগে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ প্রচার করবে, যাতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকে এবং জনগণ বিভ্রান্ত না হয়।’’ বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।