Image description

চরম অর্থ সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। টাকার অভাবে প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক মাস ধরে শিল্পীদের সম্মানী দিতে পারছে না। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ নেই তারপরও দেয়া হচ্ছে সম্মানীর চেক। এই চেক নিয়ে ঘুরছেন শিল্পীরা। ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে দফায় দফায়। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কেন এই অবস্থায় পড়েছে তা কেউ বলছেন না। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের জমানায় প্রতিষ্ঠানটিতে ইচ্ছামতো লুট হয়েছে। এখনো এই ধারা চলছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ৫০০ টাকার সম্মানীর চেক জমা দিলেও বাউন্স হচ্ছে। 

বিটিভিতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করা কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউ কেউ ৫ মাস ধরে অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও সম্মানী পাচ্ছেন না। নিয়মিত সম্মানী হিসেবে সোনালী ব্যাংকের রামপুরা শাখায় ইস্যু হওয়া চেক পেলেও তা বাউন্স হচ্ছে। দিনের পর দিন চেক নিয়ে ব্যাংকে ঘুরেও টাকা তুলতে পারছেন না। যা শিল্পীদের আর্থিক অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি। গত ৫ মাসে বিটিভি’র পক্ষ থেকে শিল্পীদের দেয়া অন্তত ৫টি চেক মানবজমিনের হাতে এসেছে। যার প্রত্যেকটি বাউন্স হয়েছে। কেউ কেউ একাধিক বাউন্স চেক নিয়ে ব্যাংকে যাওয়া আসা করছেন কিন্তু টাকা তুলতে পারছেন না। 

ওদিকে শিল্পীদের চেক বাউন্সের বিষয় বিটিভি’র মাসিক সভায়ও আলোচিত হয়। ওই বৈঠকের পর ঢাকা স্টেশনের জেনারেল ম্যানেজারকে চিঠিও দেয়া হয় বিষয়টি সুরাহা করতে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ টেলিভিশন সোনালী ব্যাংকের রামপুরা শাখা হিসাব নম্বর-১৬১৪০০১০০০৪৬৭ থেকে শিল্পীদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে শতাধিক চেক ইস্যু করা হয়। যার অধিকাংশই বাউন্স হয়। মানবজমিনের হাতে আসা এমন চারটি চেক যাচাই করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার চেকও বাউন্স হচ্ছে বলে শিল্পীরা অভিযোগ করেছেন। ব্যাংকে চেক জমা দেয়ার পরে চেক গ্রহীতাকে ব্যাংক থেকে ‘আপনার চেকের বিপরীতে উক্ত হিসাবটিতে পর্যাপ্ত টাকা নেই’ বলে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে। বিটিভি সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি ত্রুটি ও অর্থ সংকটের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লাইভ অনুষ্ঠান বন্ধ আছে। অনেক অতিথিদের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। শুধু সম্মানীই নয়, জ্বালানি ক্রয়ের অভাবে অতিথিদের যাতায়াতের জন্যও যানবাহন পরিচালনা করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এই আর্থিক সংকটের পেছনে প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়মকে দায়ী করছেন অনেকে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিভিতে কাজ করা একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, শিল্পীদের অর্থ বরাদ্দের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। এ কারণে তাদের নিয়মিত টাকা দেয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি দীর্ঘ দেড় যুগ পরে চালু হওয়া ‘নতুন কুঁড়ি’ এর অনুষ্ঠান চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। 

টেলিভিশনের স্পেশাল গ্রেডের একজন শিল্পী মানবজমিনকে বলেন, সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি পেলেও শিল্পীদের সম্মানী বাড়েনি। আমাদের  অবস্থা আগের মতোই আছে। অল্প টাকা দিলেও তা সময়মতো তুলতে পারছি না। সম্মানী হিসেবে যে টাকা পাওয়া যায়, তাতে যাতায়াতের খরচও হয় না, শিল্পচর্চার ব্যয় নির্বাহ তো দূরের কথা। আর জীবিকা নির্বাহের তো প্রশ্নই আসে না। বিটিভি থেকে যে সম্মানী আমাদের দেয়া হয় কোনো মানুষকে সেটা বলাও যায় না। বিটিভি থেকে যে চেক দেয়া হয়, তা দিয়ে ব্যাংকে গেলে টাকা তোলা যায় না। ব্যাংক থেকে বলা হয়, অ্যাকাউন্টে টাকা নাই। এই চেক দিয়ে আমাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে। যে অ্যাকাউন্টে টাকা নেই, সেই চেক শিল্পীদের কেন দেয়া হয়? 

সম্প্রতি চালু হওয়া নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় যোগ্য বিচারকদের নাম তালিকায় থাকার পরও তাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী ঘরানার লোকদের ডেকে এনে বিচারকের দায়িত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিটিভি’র হেড অব প্রোগ্রাম মনিরুল হাসান নিজের খেয়াল খুশিমতো ঘনিষ্ঠভাজনদের বিচারক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে এই অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। পক্ষপাতিত্বের কারণে এই অনুষ্ঠান ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। হামদ-নাত-এর একজন প্রতিযোগী জানান, অনুষ্ঠানে তাকে হিজাব পরা দেখে বিচারকদের দিক থেকে জিজ্ঞাস করা হয়, হামদ- নাত গাইলেই কি হিজাব পরতে হবে? 

জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী মনিরুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইআর বিভাগে ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন। ৫ই আগস্টের পরও একটি চক্র তাকে বিটিভি’র গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেছেন। এদিকে শিল্পী তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে শিল্পী তালিকাভুক্ত করার একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর একজন কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। 

শিল্পীদের টাকা না পাওয়া ও চেক বাউন্সের বিষয়ে জানতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। বিটিভি’র মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলম গোরাকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে শিল্পীদের চেক বাউন্সের বিষয়টি জানিয়ে তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি। পরে বিটিভি’র ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার নুরুল আজমকে ফোন করা হলেও তিনিও ফোন ধরেননি। মেসেজ দিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি। 

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন উপ-পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকের সঙ্গে কথা বললে তারা নিজের নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।