আসন ভাগাভাগির আলোচনা নিয়ে জট কাটতে না কাটতেই জোটের প্রতীক ব্যবহারের নিয়মে বদলের কারণে নতুন সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, এখন থেকে জোটের প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে। জোটের প্রধান দলের প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না।
এর ফলে উদ্বেগে পড়েছে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলো। বিএনপি ও জোট নেতাদের মতে, এর ফলে ছোট দলগুলোর নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, 'জোট প্রার্থীদের মাঠের অবস্থান আগে থেকেই দুর্বল। বিএনপি চেষ্টা করছে তাদের জয়ের সম্ভাবনা বাড়ানোর কৌশল বের করতে। কিন্তু নতুন নিয়মে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে।'
তিনি বলেন, 'এর ফলে বিএনপির সঙ্গে সহযোগী দলগুলোর দূরত্ব ও টানাপড়েন আরও বাড়তে পারে।'
আরপিওতে এই সংশোধনীর বিরোধিতা করে বিএনপি শিগগির নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেবে।
গতকাল শুক্রবার গুলশানে নিজের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, 'ন্যায্য রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।'
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ আরপিও সংশোধনী চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, নতুন প্রতীক নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভোটারদের কাছে প্রতিটি প্রার্থীর দলের পরিচয় স্পষ্ট করা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির সঙ্গে একযোগে আন্দোলন করা ৫০টি দলের মধ্যে দুটি জোট ও আরও পাঁচটি দল এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অধীনে ১০৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা জানিয়েছে।
বিএনপি আগেই ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচিত হলে তারা জাতীয় সরকার গঠন করবে। এ জন্য জোটের সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন ভাগাভাগি করতে চায় বলে জানান বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
পরাজয়ের আশঙ্কায় জোট নেতারা বলেন, বিএনপির প্রতীক 'ধানের শীষ' ছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের পক্ষে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব।
তারা আরও বলেন, জোটের সহযোগী দলগুলো নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে গেলে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরাও সমর্থন দেবেন না।
জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, 'ছোট দলগুলো নিজেদের প্রতীকে নির্বাচনে গেলে বড় দলের নেতাকর্মীরা সহায়তা করেন না। আরপিওর এই সংশোধন কার্যকর হলে জোট গঠনেরই কোনো মানে থাকবে না।'
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফারহাদ বলেন, 'গ্রামের মানুষ বড় দলের বাইরে ছোট দলের প্রতীক চেনেন না। দুই মাসের মধ্যে কোনো প্রতীককে পরিচিত করে তোলা খুবই কঠিন।'
তিনি বলেন, 'এর ফলে আসন ভাগাভাগি নিয়েও বিএনপির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।'
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফিজুর রহমান ইরান বলেন, নির্বাচনে প্রধান দলের প্রতীক না থাকলে বিএনপির নেতাকর্মীরা জোটের প্রার্থীদের প্রতি আগ্রহী হবেন না।
তিনি বলেন, 'ধানের শীষ প্রতীকটি কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচার হবে। কিন্তু আমার এলাকায় আমি যদি নিজের দলের প্রতীক আনারস নিয়ে নির্বাচন করি, তাহলে আর কতটা লাভ হবে? এখানে জটিলতা আছে।'
জোটের সহযোগী দলগুলোর নেতারা বলেছেন, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধন করা একেবারেই অনুচিত।
ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই আরপিও আইনে পরিবর্তন আনা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।'
সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফারহাদ বলেন, 'সরকার একের পর এক নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যার ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।'
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বলেন, 'অনেক দলের নেতারা বিপাকে পড়বেন। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি অস্বস্তিকর। তারা বিএনপির প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না।'
চারটি রাজনৈতিক দলের নেতা আরপিও সংশোধনের সঙ্গে একমত হলেও বলেছেন, রাজনৈতিক জোটগুলোর জন্য প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা উচিত।
গণতন্ত্র মঞ্চের নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'সরকার কেন এটা করল, বুঝতে পারছি না। জনপ্রিয় একটি প্রতীক ব্যবহার করতে পারলে জোটের প্রার্থীরা নির্বাচনে অনেক সুবিধা পায়।'
তিনি বলেন, 'সেই সুযোগটাই বন্ধ করে দিয়েছে। এতে কোনো বাস্তব উন্নতি তো হবে না। আমি কোনো ইতিবাচক ফলাফলও দেখি না।'
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, 'আমাদের দলের অবস্থান ইতিবাচক। নিবন্ধিত দলগুলোর উচিত নিজেদের প্রতীক ব্যবহার করা। কিন্তু, এটা যেকোনো দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আমার মতে, কোনো দল জোটে যোগ দিলে প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি সেই দলের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।'
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিও প্রিন্সের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, 'অন্য দলের প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ থাকা উচিত।'