সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ভদ্রঘাট এলাকার কুটিরচর গ্রামের ছোট্ট এক খুপড়ি ঘরে বসবাস করতেন রেশমা ও তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ভাই শামিম। মা মারা যাওয়ার পর বাবা নতুন সংসার শুরু করায় ভাইবোন দুজনই একে অপরের ভরসা হয়ে বেঁচে ছিলেন। অভাব ছিল, দারিদ্র্য ছিল, তবুও তাদের ছোট্ট ঘরটিতে ছিল হাসি, ভালোবাসা আর একে অপরকে জড়িয়ে বাঁচার সাহস।
বাড়ির পাশের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে ধীরে ধীরে সংসারে ফিরছিল স্বস্তি, ফিরছিল স্বপ্নের আলো। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কুটিরচর গ্রামের শান্ত জীবনে হঠাৎ নেমে আসে ভয়ঙ্কর অন্ধকারের ছায়া। ঘটে এমন এক নির্মম হত্যাকাণ্ড, যা স্তম্ভিত করে দেয় গোটা এলাকা।
২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রামের পাশে একটি পুকুরের কিনারায় পাওয়া যায় এক যুবকের গলায় গামছা পেঁচানো, এসিডে ঝলসানো ও ক্ষতবিক্ষত লাশ। প্রথমে লাশ শনাক্ত করা না গেলেও পরে নিহতের বাবা নিশ্চিত করেন—এটি তার ছেলে শামিমের মরদেহ। শোক ও হতাশায় ভেঙে পড়েন রেশমা।
কামারখন্দ থানায় দায়ের করা হয় একটি হত্যা মামলা।
ঘটনার তদন্তে মাঠে নামে সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশ। তবে শুরুতে মামলাটি ছিল সম্পূর্ণ রহস্যে ঘেরা—কোনো ক্লু, কোনো সাক্ষী কিছুই ছিল না। দুই মাসেরও বেশি সময় পর তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এক সন্দেহভাজন যুবক তপু।
তপুর ফোনের মেসেজে মেলে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। ডিবি কর্মকর্তারা মেসেজ বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, ঘটনার রাতেই তপু তার বান্ধবীর সঙ্গে কথোপকথনে শামিম হত্যার বর্ণনা দিচ্ছে। এই তথ্য হাতে পেয়ে তদন্তের নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
গ্রেপ্তারের পর তপু জানায়, শামিমকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী তারই বোন *রেশমা*। খবরটি শুনে হতবাক হয়ে যায় তদন্ত কর্মকর্তারা ও গ্রামবাসী। নিজের ভাইকে হত্যা—এমন অমানবিক ঘটনার খবর বিশ্বাস করতে পারেননি কেউই।
তপুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সেদিন রাতে রেশমা তার সহকর্মী গোলাম মোস্তফা, সুমন চন্দ্র ভৌমিক ও শফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করেন শামিমকে হত্যা করার।
শামিমকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এক সহযোগীর বাড়িতে। সেখানে রেশমা নিজ হাতে তার ভাইয়ের শরীরে এসিড ঢালেন, শফিকুল তার বুকে ছুরিকাঘাত করে। মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে শামিমের দেহ। পরে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় গ্রামের পাশের একটি পুকুরে।
তদন্তে উঠে আসে, রেশমা জড়িয়ে পড়েছিলেন অনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থলোভী কর্মকাণ্ডে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ভাই শামিম তার এসব কাজের প্রতিবাদ করায় রেশমা ও তার সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তাকে।
রেশমা ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সবাই হত্যার দায় স্বীকার করে। পরে আদালতে *১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী* দেন রেশমা ও আরও তিনজন সহযোগী।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারকেই ভেঙে দেয়নি, বরং প্রশ্ন তুলেছে গোটা সমাজের নৈতিকতা নিয়ে। যেখানে একটি বোন নিজের ভাইকে হত্যা করতে পারে, সেখানে মানবতার স্থান কোথায়?
অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব—পরিবার থেকেই যদি ন্যায় ও মূল্যবোধ হারিয়ে যায়, তবে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে।