Image description

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কিশোরী এক মাদরাসা ছাত্রীকে অপহরণ এবং ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়েছে, উপজেলার মৌচাক এলাকায় ১৩ বছর বয়সী মাদরাসা ছাত্রীকে এক হিন্দু প্রতিবেশি যুবক ও তার সহযোগীরা অপহরণ করে তিন দিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করেছে। মূল অভিযুক্তের নাম জয় কুমার দাস বলে ওইসব পোস্টে জানানো হয়েছে। বেশ কয়েকজন অনলাইন এক্টিভিস্টের পোস্টে অভিযুক্তদেরকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে করা হয়েছে। 

এমন একজন এক্টিভিস্টের পোস্টে লেখা হয়েছে, “হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের ধর্ষণ এর শিকার মেয়েটির নাম …। বয়স ১৩ বছর।” ওই এক্টিভিস্টসহ আরও অনেকে মেয়েটির প্রকৃত নাম প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছেন। তবে দ্য ডিসেন্ট এই প্রতিবেদনে ভিকটিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম উহ্য রেখে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছে।

এদিকে ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ থেকে এই ঘটনায় একটি পোস্ট করে যেখানে বলা হয়, “১৩ বছর বয়সী মেয়ের সাথে উক্ত এলাকার জয় কুমার দাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি ইতিপূর্বে দুইবার জয় কুমার দাসের সাথে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় ফিরে আসে। গত ২০ আগস্ট মেয়েটি পুনরায় ওই যুবকের সাথে পালিয়ে যায় এবং ২ দিন পর বাসায় ফিরে আসে।”

দ্য ডিসেন্ট সরেজমিনে অনুসন্ধান করে ঘটনাটির বিভিন্ন দিক জানার চেষ্টা করেছে। ১৮ অক্টোবর দিনব্যাপী দ্য ডিসেন্ট এর প্রতিবেদক ভিক্টিমের পরিবার, ক্লাসমেট, মাদরাসা শিক্ষক, প্রতিবেশি,  অভিযুক্তের পরিবার, অভিযুক্তদের সহ-ব্যবসায়ী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং পুলিশসহ ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের অন্তত ৩০ জনের সাথে কথা বলেছেন। তবে ভিকটিমের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে দিতে পরিবারের অনাগ্রহের কারণে তার সাথে কথা হয়নি।

 

ঘটনা সামনে আসে দেড় মাস পর

ভিকটিমকে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের যে অভিযোগ সেই ঘটনাটি ঘটেছে গত ২০ আগস্ট। তবে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে এটি ভিকটিমের পরিবার ও আশপাশের দু’চারজন ব্যক্তি (বিশেষ করে তাদের বাড়িওয়ালা) ছাড়া আর কেউ জানতো না। 

গত ১১ অক্টোবর ভিকটিমের মা অভিযুক্তদের একজন লোকনাথ চন্দ্র দাসকে তার দোকানে (যেখানে সে একজন কর্মচারী) ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে যান। তখন লোকনাথ এবং তার দোকানের মালিক ও বোনজামাই সঞ্জিত বর্মণ মিলে ভিকটিমের মাকে মারধর করলে পুরো ঘটনাটি এলাকাবাসীর মধ্যে জানাজানি হয়।

এরপর সেটি সামাজিক মাধ্যমেও চলে আসে। অভিযুক্তের বিচারের দাবিতে অনলাইন এক্টিভিস্টদের অনেকে পোস্ট করতে থাকেন। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ঘটনায় জড়িতের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে।

এরমধ্যে ১৪ অক্টোবর রাতে স্থানীয় কয়েকজন যুবক মিলে দুই অভিযুক্ত জয় কুমার দাস (২০) ও লোকনাথ চন্দ্র দাসকে (২০) ধরে পুলিশের কাছে নিয়ে যান। এরপর ভিকটিমের মা অভিযুক্ত জয়, লোকনাথ এবং লোকনাথের বোনজামাই ও স্থানীয় দোকানদার সঞ্জিত বর্মণ (২৬)– মোট তিনজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে কালিয়াকৈর থানায় মামলা দায়ের করেন।

 

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে

মামলায় জয় কুমার দাসকে প্রধান আসামি এবং তার বিরুদ্ধে (ভিকটিমকে) ‘ফুসলিয়ে এবং ভুল বুঝিয়ে’ অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি দুইজনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়েছে।

ভিকটিমের মায়ের স্বাক্ষরিত এজাহারে লেখা হয়েছে: “২ নং বিবাদী (লোকনাথ) আমাদের বর্তমান ঠিকানায় একই বাসায় বসবাস করিত। ১ নং বিবাদী (জয় কুমার) ২ নং বিবাদীর সম্পর্কে ভাগিনা। ২ নং বিবাদীর উক্ত বাসায় ১ নং বিবাদী যাতায়াত করিতো। সেই সুবাদে অনুমান ৪ মাস পূর্বে ১ নং বিবাদী আমার মেয়ে (নাম উহ্য রাখা হলো)-কে বিভিন্নভাবে ভুল বুঝাইয়া ও ফুসলাইয়া প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক গড়িয়া তোলে। আমি ও আমার স্বামী আমাদের কর্মস্থলে থাকার সুবাদে আমার মেয়ে (নাম উহ্য রাখা হলো) ইং ২০/০৮/২০২৫ তারিখ সকাল অনুমান ০৮.০০ ঘটিকার সময় কালিয়াকৈর থানাধীন পূর্ব মৌচাক সাকিনস্থ সিকদার বিল্লাহ এর বাড়ীর আমার ভাড়াটিয়া বাসার সামনে গেলে ২ ও ৩ নং বিবাদীদ্বয়ের সহায়তায় ১ নং বিবাদী আমার মেয়েকে বিভিন্নভাবে ফুসলাইয়া ও ভুল বুঝাইয়া আমার মেয়েকে অপহরন করতঃ ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন বান্দুরা সাকিনস্থ ২ নং বিবাদী লোকনাথ চন্দ্র দাস এর ভাড়াকৃত বাসায় নিয়া যায়। উক্ত বাসায় নেওয়ার পর ইং ২০/০৮/২০২৫ তারিখ রাত অনুমান ০৮.০০ ঘটিকার সময় ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন বান্দুরা সাকিনস্থ ২ নং বিবাদী লোকনাথ চন্দ্র দাস এর ভাড়াকৃত বাসার ভিতর ২ ও ৩ নং বিবাদীদ্বয়ের সহায়তায় ১ নং বিবাদী জয় কুমার দাস আমার মেয়েকে বিভিন্নভাবে ভুল বুঝাইয়া... (নাম উহ্য রাখা হলো) ... আমার মেয়েকে ধর্ষন করে। পরবর্তীতে ২ ও ৩ নং বিবাদীদ্বয়ের সহায়তায় ১ নং বিবাদী একই বাসায় আমার মেয়েকে ইং ২২/০৮/২০২৫ তারিখ পর্যন্ত একাধিকবার ধর্ষন করে।”

 

ভিকটিমের মাকে মারধর করে দুই আসামি

ঘটনার দেড় মাস পরে (১১ অক্টোবর) কেন অভিযুক্তদের সাথে কথা বলতে দোকানে গিয়েছেন, এবং তাৎক্ষণিক কেন আইনের আশ্রয় নেননি- ভিকটিমের মাকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনার পর তার মেয়ে বাড়িতে ফিরে এলে অপরিচিত নম্বর থেকে কল করে এই ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দেয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, “ফোন করে আমারে বলছে যদি বাড়াবাড়ি করি তাহলে মেয়ের মতো মায়েরও অবস্থা করবে। আমার এত বড় মেয়ে, ভয় আর মানসম্মানের কথা চিন্তা করে আমরা ঘটনাটা নিয়ে আর কিছু করি নাই। আমরা এই এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকি। আমাদের আর কেউ নাই এখানে। হুমকির পর আমার মেয়েকে গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে পাঠাই দেই। ও খুবই অসুস্থ্য হয়ে পড়ছিল। তাই এখানে রাখা নিরাপদ মনে করিনি।”

ভিকটিমের মা জানান, ঘটনার পর তার মেয়ের প্রথমে কথা বলতে চায়নি এবং শারীরিক মানসিকভাবেও কথা বলার অবস্থায় ছিল না। কয়েকদিন পরে মেয়ে জানায় তাদের পূর্ব পরিচিত জয় কুমার তাকে ধর্ষণ করেছে এবং জয়ের মামা লোকনাথ তাতে সহযোগিতা করেছে।

লোকনাথ তার স্ত্রীসহ মাস তিনেক আগ পর্যন্ত ভিকটিমের পাশের বাসায় ভাড়া থাকতেন। সেই বাসায় তার ভাগনে জয় কুমার অন্তত দুইবার বেড়াতে এসে কয়েকদিন করে থেকেছিলো বলে ভিকটিমের পরিবার ও প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। 

লোকনাথের পরিবারের সাথে ভিকটিম ও তার মায়ের জানাশোনা ও সদ্ভাব রয়েছে। লোকনাথ সম্প্রতি বাসা বদলে ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় চলে গেলেও ভিকটিমদের বাসার পাশে তার বোনজামাই সঞ্জিত বর্মণের দোকানে এখনও চাকরি করেন। এবং জয় কুমার বর্তমানে লোকনাথের বাসার সাথে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন।

ভিকটিম ২২ আগস্ট বাড়িতে ফেরার পর থেকে লোকনাথ ওই দোকানে আসেনি বলেন দাবি করেন ভিকটিমের মা। ১১ অক্টোবর তিনি খবর পান লোকনাথ দোকানে এসেছে এবং রাত সাড়ে ১১ টার দিকে সঞ্জিত ট্রেডার্সে যান। সেখানে লোকনাথকে দেখতে পেয়ে ‘মেজাজ হারান’ ভিকটিমের মা। এবং তাকে প্রশ্ন করেন কীভাবে তার মেয়ের ‘সর্বনাশ’ করলো। এতে উভয়ের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হলে ভিকটিমের মায়ের গায়ে হাত তুলেন লোকনাথ ও সঞ্জিত। তাকে মেরে দোকানের বাইরে নিয়ে আসেন। সে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে দ্য ডিসেন্ট

ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১১ টা ৩৬ মিনিটে ভিকটিমের মা দোকানে ঢুকেন। এক মিনিটের মধ্যেই ১১টা ৩৭-এর দিকে তাকে এক পুরুষ ব্যক্তি হাত দিয়ে মারতে মারতে দোকানের বাইরে নিয়ে আসেন। পাশের দোকান মহসিন ইলেক্ট্রেকি এন্ড রেফ্রিজারেটর এর স্বত্ত্বাধিকারী শাকিল আহমেদ ফুটেজে দৃশ্যমান মারধরকারী ব্যক্তিকে সঞ্জিত বর্মণ বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি এবং স্থানীয় অন্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, লোকনাথ এবং সঞ্জিত দুইজন মিলেই ভিকটিমের মাকে পিটিয়েছিলেন।

ভিকটিমের মাকে মেরে দোকান থেকে বের করে দিচ্ছেন সঞ্জিত ও লোকনাথ

ভিকটিমের মাকে মেরে দোকান থেকে বের করে দিচ্ছেন সঞ্জিত ও লোকনাথ | সিসিটিভি ফুটেজ

এরপর ঘটনাস্থলে লোকজন জড়ো হলে এলাকাবাসী জানতে পারেন দেড় মাস আগে সংঘটিত ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি। তখন জনরোষের ভয়ে দোকান থেকে পালিয়ে যায় লোকনাথ।

ওই রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পাশের ফার্মেসি দোকানকদার মো. উবায়দুল ইসলাম দ্য ডিসেন্ট-কে বলেন, “চিল্লাচিল্লি শোনে আমি যাই। যখন আমরা প্রতিবাদ শুরু করি তখন লোকনাথ অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে যায়।”

স্থানীয় আরেকজন ব্যক্তি জানান, লোকনাথকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সঞ্জিতের দোকানে যাওয়ার পর ভিকটিমের মা পায়ের জুতা খুলে লোকনাথকে আঘাত করলে তাদের মধ্যে হাতাহাতি বাঁধে বলে তিনি শুনেছেন।

পরদিন ১২ অক্টোবরও দোকান খোলা ছিল সঞ্জিত বর্মণের। নৈশপ্রহরীর বরাতে ওই ফার্মেসি দোকানি জানান, ১২ তারিখ রাতে আনুমানিক এক থেকে দেড়টার দিকে দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নেয় সঞ্জিত। পরদিন থেকে আর দোকান খুলেনি। 

১৮ অক্টোবর সরেজমিনে দোকানটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সঞ্জিব ট্রেডার্সের সামনের আরেকটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। ওই ঘরের সামনে ‘দোকান ভাড়া দেওয়া হবে’ লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখেছেন এই প্রতিবেদক।

সাইনবোর্ড ছেঁড়া অবস্থায় তালাবদ্ধ সঞ্জিত ট্রেডার্স

সাইনবোর্ড ছেঁড়া অবস্থায় তালাবদ্ধ সঞ্জিত ট্রেডার্স | মাহবুব এ রহমান/দ্য ডিসেন্ট

সঞ্জিতের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। মামলার ৩ নং এই আসামি ২১ অক্টোবর এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন। অন্য দুই আসামি কারাগারে আছেন।

২২ আগস্ট বাসায় ফেরার পর ভিকটিমের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভাল না থাকায় পরিবার তাকে গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে পাঠিয়ে দেয়। ১১ তারিখ রাতের ঘটনার পর স্থানীয় এলাকাবাসী, মসজিদের ইমাম ও আলেমসমাজ এ ঘটনায় সোচ্চার হন৷ ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট করেন অনেকে। এরপর এলাকাবাসীর কাছে বিচারের আশ্বাসে পরদিনই কুড়িগ্রাম থেকে মেয়েকে মৌচাকে নিয়ে আসে পরিবার৷ যদিও তখনও গুরুতর অসুস্থ ছিল সে।

স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বার ফখরুল ইসলাম মজুমদার দ্য ডিসেন্টকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারাও ঘটনাটি ঘটার পর শুনেন নি। নাহলে তারাই বিচারিক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতেন।

 

জয়ের সাথে ভিকটিমের কী সম্পর্ক?

বাবা-মার চাকরির সুবাদে ৪নং মৌচাক ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত ভান্নারা রোডের পূর্ব মৌচাকের সিকদার ভিলায় বছরখানেক ধরে ভাড়া থাকে ভিকটিমের পরিবার। ধর্ষণে অভিযুক্ত জয় কুমার দাসের মামা লোকনাথ তার স্ত্রীসহ ভিকটিমের পাশের ঘরে ভাড়া থাকতেন।

সরেজমিনের দেখা যায়, মূল রাস্তার সাথে ছোট্ট একটা গেট দিয়ে ঢুকলেই সিকদার ভিলা। ভেতরে দুই পাশে টিনশ্যাডের ছোট ছোট ঘরের দুটি সারি। দুই সারি ঘরের মাঝখানে ছোট্ট একটা রাস্তা৷ সেখানে থাকা ১০টি ঘরে ১০টি পরিবারের বসবাস। মূলত মৌচাক এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিকরাই এখানে ভাড়া থাকেন।

গেট দিয়ে ঢুকেই শুরুতে ডান দিকের একটি কক্ষে ভিকটিমের পরিবারের থাকে৷ এর ঠিক বিপরীতে একটি কক্ষে জয় কুমারের মামা লোকনাথ চন্দ্র দাস পরিবারসহ থাকতেন। আনুমানিক ৩ মাস আগে তারা অন্যত্র চলে যান। প্রায় ৬ মাস তারা এই কক্ষে বসবাস করেছিলেন, বলে জানান ভিকটিমের মা ও প্রতিবেশিরা।

টিনশ্যাড ঘরের সারি

টিনশ্যাড ঘরের সারি | মাহবুব এ রহমান/দ্য ডিসেন্ট

লোকনাথের পরিবারের সাথে প্রতিবেশি হিসেবে ভিকটিমের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। লোকনাথ ও তার স্ত্রী এখানে থাকার সময় অন্তত দু’বার জয় কুমার এসে মামার বাসায় কয়েকদিন থেকেছে। প্রথমবার চাকরির খোঁজে, অন্যবার ঘুরতে৷ এ সময় ভিকটিম মেয়েটিসহ প্রতিবেশিদের সাথে জয় কুমারের দেখা সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়।

জয় কুমারের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ভিকটিমের বাবা জানান, লোকনাথ দম্পতি তার মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মেয়েটিও মাঝে মধ্যে তাদের ঘরে ঘুরতে যেত।

লোকনাথের পরিবার এখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও ভিকটিমের মায়ের সাথে যোগাযোগ ছিল। কিছুদিন আগেও লোকনাথের স্ত্রী পুষ্পা অসুস্থ থাকায় ভিকটিমের পরিবারের সাথে ইমোতে ভিডিও কলে কথা বলেন বলে ভিকটিমের মা জানান।

প্রতিবেশি হিসেবে পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে মেয়ের সাথে অভিযুক্ত জয় কুমারের আলাদা কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তা জানেন না ভিকটিমের মা। 

দ্য ডিসেন্টকে তিনি বলেন, ‘‘কখনও অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলে বা কোনো সন্দেহ করলে আমাকে দেখাতো। এর বাইরে ওই ছেলের বা কারো সাথে কোনো সম্পর্ক আমার জানা নাই।’’

প্রতিবেশি আরেক গৃহবধূ তামান্নাও একই দাবি করেন। ‘‘ওর পরিবারের সাথে লোকনাথের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু লোকনাথের ভাগনার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক ছিল এমনটা দেখিনি। বুঝিওনি।' বলেন তামান্না।’’

তবে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। স্থানীয় ফার্মেসি দোকানদার মো. উবায়দুল ইসলাম, যার কাছ থেকে নিয়মিত ওষুধ কিনতো ভিকটিমের পরিবার। তিনি দ্য ডিসেন্টকে বলেন, ‘‘এটা ১০০% প্রেমের ফাঁদ।’’

 

অপহরণ নাকি স্বেচ্ছায় গমন?

মামলার এজাহারে ভিকটিমের মা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ আনলেও দ্য ডিসেন্ট এর সাথে আলাপে তিনি যা বলেছেন তাতে ভিন্ন কিছু বিষয় উঠে এসেছে।

ভিকটিম মেয়েটি স্থানীয় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। তার ছোট ভাইও একই মাদরাসার ভিন্ন একটি ক্লাসের শিক্ষার্থী। মা-বাবা দুজনই গার্মেন্টস কর্মী। মা নিট প্লাস লিমিটেডে কাজ করেন এবং বাবা রহমত টেক্সটাইলে কাজ করতেন (ঘটনার পর মেয়েকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে বাবার চাকরি চলে যায়)। তারা উভয়ে সকালে কাজে চলে যান। এরপর মেয়ে এবং ছেলে একসাথে মাদরাসায় যান। স্বাভাবিক সময়ে ভাইবোন ক্লাস শেষ করে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বাসায় ফেরেন। আর মা দুপুরের খেতে আসেন সাড়ে ১২টার দিকে। ঘটনার দিন আগে রাতে বাবার নাইট ডিউটি থাকায় সকালে তিনি ঘুমাচ্ছিলেন এবং মা মেয়ে এবং ছেলেকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করে কাজে চলে যান। এরপর দুই ভাইবোন বের হন মাদরাসায় যাওয়ার জন্য। গেটে পর্যন্ত একসাথে গিয়ে নিজের ক্লাস রুমে চলে যায় ছোট ভাই। ওইদিন দুপুর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি ভিকটিমকে।

মেয়ে যে, ওইদিন মাদরাসার জন্য রওয়ানা হয়ে ক্লাসে যায়নি এটা পরে প্রতিবেশি ও মাদরাসা সূত্রে জেনেছেন বলে স্বীকার করেন মা।

মাদরাসাটির চতুর্থ শ্রেণির হাজিরা খাতার রেকর্ডও বলছে, ভিকটিম সেদিন ক্লাসে যায়নি। তবে আগেরদিন ক্লাসে উপস্থিত ছিল।

চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক মায়মুনা আক্তারও দ্য ডিসেন্টকে ওর সেদিনের অনুপস্থিতির ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। দেরিতে ক্লাসে গিয়ে থাকলে হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নাও উঠতে পারে এমন সন্দেহ থেকে ভিকটিমের কয়েকজন সহপাঠীর সাথে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারাও জানিয়েছেন সেদিন ক্লাসে আসেনি ভিকটিম।

সহপাঠী রাজিয়া আক্তার বলেন, “ও যাওয়ার আগের দিন আমাদেরকে বলছে আমি কালকে থেকে আর আসবো না। তোরা আমার কথায় কিছু মনে করিস না।”

মাদরাসার মোহতামিম (প্রিন্সিপাল) মাওলানা আব্দুল করিম জানান, “ও মাদরাসায় নিয়মিত আসতো না। এ নিয়ে ওর বাবা-মায়ের সাথেও যোগাযোগ করেছি একাধিকবার।”

“ওকে না পেয়ে এদিন দুপুরের পর ওর বাবা মাদরাসায় আমার কাছে আসেন। আমিও আমাদের সম্ভাব্য পরিচিত জায়গায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু পাইনি।” বলেন আব্দুল করিম।

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র) মাদরাসা ও এতিমখানা

হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র) মাদরাসা ও এতিমখানা | মাহবুব এ রহমান/দ্য ডিসেন্ট

মেয়েটি স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় মায়ের কথায়।

তিনি বলেন, “তবে ওকে যেদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেদিন দুপুরে ফিরে আমি ঘরের মোবাইলটা খুঁজে পাইনি। সাথে ঘরে রাখা ৫ হাজার টাকাও পাচ্ছিলাম না। প্রথমে ভাবছিলাম চুরি হলো কিনা। কিন্তু পরে দেখলাম মেয়েটাও আসতেছে না। তখন বুঝলাম ওই নিয়েছে এসব।”

মা আরও জানান, “(ফিরে আসার পর) মেয়ে বলেছে লোকনাথ ওর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছে। সেটা দিয়ে ওরা খাওয়ার জন্য বাজার করেছে।”

তবে মায়ের দাবি, তার মেয়ে স্বেচ্ছায় এভাবে চলে যাওয়ার মতো মেয়ে না। ওকে জয় কুমার দাস ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গেছে।

প্রতিবেশি গৃহবধু তামান্নার ভাষ্যমতে, ভিকটিমের মা দুপুরের খাবার বিরতিতে বাসায় ফিরে দেখেন ছেলে ফিরলেও মেয়ে এখনও ফেরেনি। পরে মা-বাবা মেয়েকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেন। তাদের পূর্ব পরিচিত লোকনাথসহ স্থানীয় অন্যান্য দোকানিদেরকে মেয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। লোকনাথ ওইদিন জানায় সে কিছুই জানে না। এরপর ওইদিন কালিয়াকৈর থানায় একটি জিডি করেন বাবা।

এর ৩ দিন পর বাসায় ফিরে আসে ভিকটিম।

২২ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে মৌচাকে রাস্তার ধারে ভিকটিমকে দেখতে পান তারই এক প্রতিবেশি নারী (ভিকটিম যাকে নানি বলে ডাকতো)। ওই নারী দুপুরের পর মেয়ের জন্মনিবন্ধন কার্ড ফটোকপি করতে গেলে একটি দোকানের পাশে ভিকটিমকে দেখতে পান। পরে তাকে বাসায় নিয়ে আসেন।

“রাস্তায় ঢলতে ঢলতে আসতে দেখি মেয়েটাকে। তাকে দেখেই আমি চিনে ফেলি। সে তেমন কথা বলতে পারছিল না। এমন অবস্থায় আমি ওকে বাসায় নিয়ে আসি” বলেন ওই নারী৷

ভিকটিমের ঘরের বিপরীত দিকে ঘরটিতে বর্তমানে ভাড়া থাকেন আরেক দম্পতি। সে গৃহবধু দ্য ডিসেন্টকে জানান, “যখন তাকে সেদিন নিয়ে আসা হয়, মৃত্যুশয্যার মতো অবস্থায় আমরা দেখি।”

 

কোথায় গিয়েছিল? সেখানে কী ঘটেছিল?

মামলার এজাহার অনুযায়ী, ভিকটিমকে লোকনাথ ও সঞ্জিতের সহযোগিতায় কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকা (মেয়ের ঠিকানা) থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার নবাবগঞ্জের বান্দুরা এলাকায় লোকনাথের বাসায়। 

ভিকটিমের মায়ের তথ্য মতে, ওটা লোকনাথের শশুরবাড়ির এলাকা। “ওখানেই এখন ওরা থাকে। সেখানে এক ইউনিটে লোকনাথ ও তার বউ থাকে। আরেক ইউনিটে জয় কুমার দাস তার এক বন্ধুকে নিয়ে থাকে। ওইখানে ওরা মেয়েকে নিয়ে রাখে।”

“ওরা আমার মেয়েকে মেডিসিন (পিল) খাইয়েছে। ধর্ষণের পর ভাত খাইয়ে সারারাত উলঙ্গ রেখেছে। লোকনাথের বউ ও বউয়ের বোন মেয়ের বোরকা, হাত ও পা মোজা ফেলে দেয়”, বলেন মা।

এসব তথ্য তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন বলে জানান। তার অভিযোগ, ওখানে আটকে রেখে তিন দিন ভিকটিমকে ধর্ষণসহ শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে জয় কুমার। এসবে তাকে লোকনাথ, তার স্ত্রীর ও স্ত্রীর বোনও সহায়তা করেছে বলে মাকে ভিকটিম বলেছে। সহযোগিতার অভিযোগ সঞ্জিতের বিরুদ্ধেও।

“এসব লোকনাথ ও সঞ্জিতের পরিবারের যোগসাজশে হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার দিন লোকনাথ ও সঞ্জিত বাইকে করে তাকে মৌচাক পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। পরে লোকনাথের বাসায় পৌঁছার পরে সেখানে মেয়ের নিয়ে যাওয়া টাকায় বাজার করে এবং লোকনাথের স্ত্রী পুষ্পা ও তার বোন রান্নাবান্না করে”, বলেন মা।

তার দাবি, “যখন আমরা জিডি করেছি সেটা শুনে তারা হয়তো ভেবেছে আমরা মামলা করেছি। তাই পরে মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় মৌচাকে রেখে যায়।”

জয় কুমার ছাড়া অন্য কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণে অভিযোগ করেছে কিনা ভিকটিম, এমন প্রশ্নের জবাবে মা বলেন, “এ বিষয়ে মেয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারেনি। কারণ ওষুধ খাওয়ানোর পর অনেক্ষণ সে অজ্ঞান ছিল বলেছে।”

মায়ের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে পলাতক আসামি সঞ্জিত বর্মণের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

ধর্ষণের আলামত রয়েছে কিনা তা জানতে ভিকটিমের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হলেও ২১ অক্টোবর পর্যন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মাযহারুল হক বলেন, ‘‘গত বৃহস্পতিবার ভিক্টিমের টেস্ট করেছি আমরা। এখনও রিপোর্ট হয়নি। দ্রুত দেওয়ার চেষ্টা করবো আমরা।’’

ভিক্টিম এখনও চিকিৎসাধীন। তবে তার অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মেডিকেল সুত্র জানিয়েছে।

লোকনাথের মা ইতি রানী দাস থাকেন টাঙ্গাইলের নাগরপুরে গ্রামের বাড়িতে। তিনি পাকুটিয়া ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক মহিলা মেম্বার; দায়িত্বে ছিলেন ২০১৬-২০২১ পর্যন্ত। অভিযুক্ত সঞ্জিত বর্মণ তার মেয়ের জামাই।

ইতি রানী দাসের কাছে লোকনাথের স্ত্রী পুস্পার মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি বলেন, তার কাছে নাই। তিনি কীভাবে যোগাযোগ করেন প্রশ্ন করলে তার ছেলেরবউ মোবাইল ব্যবহার করেন না বলে জানান।

পুষ্পার মোবাইল না থাকলে তার ছোট বোনের (ভিকটিমের মায়ের দাবি মতে যিনি ধর্ষণের ঘটনার সময় লোকনাথের বাসায় ছিলেন) নম্বর চাইলে ইতি রানী বলেন, 'ওর তো ছোট বোন টোন নাই।'

বেয়াইর পরিবারের কারো যোগাযোগ নম্বর চাইলে তিনি কারো নাম্বার নাই বলে জানান। ”আমি ওদের বাড়িতে যাইনা, কারো সাথে আমার পরিচয় নাই”, বলেন তিনি।

ছেলে এবং মেয়ের জামাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে ইতি রানী বলেন, এসব ঘটনার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। লোকনাথের গ্রেফতারের বিষয়েও তিনি কিছু জানতে পারেননি আগে। তবে লোকনাথকে আটকের সময় তিনি মৌচাকে মেয়ের বাসায় (সঞ্জিতের বাসায়) ছিলেন বলে জানান।

ছেলে আটকের সময় তিনি কিছু জানতে পেরেছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ইতি রানীর মন্তব্য, "একজনের বাসা থেকে আরেকজনের (লোকনাথ ও সঞ্জিতের) বাসা তো বেশ দূরে। তখন এসব ব্যাপারে জানতাম না কোনো কিছু।"

জয় কুমারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “ও আমাদের এমনিতে আত্মীয় না, পাড়া-প্রতিবেশি।” জয়ের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের জানা ছিল না বলেও জানান তিনি। 

‘‘লোকনাথও এসব (ধর্ষণের) ব্যাপারে জানতো না। জানলে কী আর এসব ঘটনা হতে পারে?’’ বলেন ইতি রানী।

তিনি আরও বলেন, ‘‘ওর (জয় কুমার দাস) বাবা মারা গেছে। পরে মায়ের আবার আরেক জায়গায় বিয়ে হইছে।’’

১৪ অক্টোবর রাতে যখন স্থানীয় কয়েকজন যুবক মিলে জয় এবং লোকনাথকে ধরে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যায় তখনকার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি কিছুটা আক্রমাণাত্মকভাবে জয়কে অপহরণ ও ধর্ষণের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। দ্য ডিসেন্ট জিজ্ঞাসাবাদকারী ব্যক্তির পরিচয় বের করে তার সাথে কথা বলেছে; তিনি ঢাকার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি।

ভিডিওতে দেখা যায় ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে জয় বলছে, “ও আমাকে লাভ করতো। ও আমারে নিয়া যাইতে বলছে আমি যাই নাই৷ বিধায় একা চলে গেছে, (বলছে) আমারে রিসিভ করে নিয়া যাও নইলে সুইসাইড করমু। তাই বাধ্য হয়ে আমি রিসিভ করছি।”

“দুই রাত কী করছো ওর সাথে?” সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে জয় বলেছে, “আমি প্রথম দিনই ওরে বুঝাইছি (ফিরে যেতে), ও যায়নি। ওয় আইবো না, ওয় থাকবো আমার সাথে৷ এরপর বুঝাই ওরে পাঠাই দিছি বাড়িতে।”

“ধর্ষণ করছো কিনা” জিজ্ঞেস করলে, সে অস্বীকার করে এবং বলে, “ওরে জিজ্ঞেস করেন”। ভিকটিম তো ধর্ষণের অভিযোগ করেছে তাহলে তুমি অস্বীকার করছো কেন? এমন প্রশ্নে জয় উত্তরে বলে, “ওয় আমাকে লাভ করতো, লাইক করতো।”

আবার প্রশ্ন করা হয়, “ভালোবেসে তোমরা একসাথে ছিলা?” এতে জয় উত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে, “এইটাই, ভালোবাসতো।”

“দুই রাতে কতবার সহবাস করেছো”, বারবার এমন প্রশ্ন করা হলে জয় কখনো, অস্বীকার করেছে, কখনো নীরব ছিল, আবার কখনো বলেছে, “ওর কাছ থেকে সবকিছু শুইনেন।”

 

জয়ের টিকটক একাউন্টে যা পাওয়া গেল

চেষ্টা করেও ধর্ষণে অভিযুক্ত জয়ের পরিবার বা বন্ধুবান্ধব কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যাপারে জানতে তার টিকটক একাউন্ট পর্যবেক্ষণ করেছে দ্য ডিসেন্ট

আইডিতে ৯৯টি ভিডিও রয়েছে এবং প্রথম পোস্ট পাওয়া গেছে চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি। এসব ভিডিওর বেশ কয়েকটিতে জয়ের ব্যক্তিগত জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

যেমন ৫ এপ্রিল হিজাব পরা একটি মেয়ের স্লো-মোশনের ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করেছে যেটির ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি ছেলে কণ্ঠে ভাজছিল 'ওই কিরে....মধু...মধু...' শীর্ষক চটকদার একটি কথা।

২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর দু’জন মেয়ের সাথে দুটি ছবি দিয়ে ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করেছে। ২১ তারিখের ভিডিওতে একটি মেয়ের সাথে দাঁড়ানো একটি ছবি মিউজিক যুক্ত করে ভিডিও আকারে পোস্ট করা হয়েছে। মেয়ের চেহারা একটি স্টিকার দিয়ে ঢেকে দেওয়া।

২২ সেপ্টেম্বর মিউজিকসহ জয় কুমার ও একজন তরুণীর সেল্ফি পোস্ট করা হয় যেখানে তরুণীর চেহারা অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। 

বেশ কয়েকটি ভিডিওতে মদ পান ও মদের বোতলের ছবি যুক্ত পোস্ট ভিডিও আকারে মিউজিকসহ পোস্ট করা হয়েছে। এই আইডি থেকে সর্বশেষ পোস্ট করা হয় গত ৩ অক্টোবর।

এর বাইরে যেসব পোস্ট রয়েছে সেগুলোতে আওয়ামী লীগের বন্দনা, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, পূজার উদযাপন ইত্যাদি দেখা গেছে। তার প্রোফাইলের ‘বায়ো’তে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি উল্লেখ করা রয়েছে।

জুন মাসের ২৬ তারিখে একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে জয় লিখেছেন, “আওয়ামী লীগ ফিরবে খুব ভয়ঙ্কর রূপে”। ভিডিওতে জয় তার নিজের কিছু ছবি যুক্ত করেছেন যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের পক্ষে কোন একটি নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে ক্যাম্পেইন করছেন।

 

পুলিশ ও পরিবারের বক্তব্যে অমিল

১৮ অক্টোবর দুপুরে বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে একটি বিবৃতি দেয়া হয়, যেখানে বলা হয়, “১৩ বছর বয়সী মেয়ের সাথে উক্ত এলাকার জয় কুমার দাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি ইতিপূর্বে দুইবার জয় কুমার দাসের সাথে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় ফিরে আসে। গত ২০ আগস্ট মেয়েটি পুনরায় ওই যুবকের সাথে পালিয়ে যায় এবং ২ দিন পর বাসায় ফিরে আসে।”

কিন্তু ভিকটিমের মা-বাবা পুলিশের এই পোস্টের “মেয়েটি ইতিপূর্বে দুইবার জয় কুমার দাসের সাথে পালিয়ে যায়” অংশটিকে ‘অসত্য ও বানোয়াট’ বলে অভিহিত করেছেন।

“পূর্বের দুইবার পালিয়ে যাওয়ার দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা” বলেছেন মেয়ের মা।

মা এবং বাবা দাবি করেন, মেয়ে পূর্বে পালিয়েছে পুলিশকে এমন কোনো কথা তারা বলেননি। মেয়েও বলেনি।

“থানায় মেয়েকে ও জয়কে একসাথে করে কথা বলেছে পুলিশ। এসময় পূর্বে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করাও হয়নি। আমরাও কিছু বলিনি। আগে পালানোর কোন ঘটনা ঘটেনি”, বলেন ভিকটিমের মা।

তবে তাদের মেয়ে যে, স্বেচ্ছায় ঘর থেকে মোবাইল ও ৫ হাজার টাকা নিয়ে তাদেরকে কিছু না বলে বরে হয়েছিল এবং ভাইয়ের সাথে মাদরাসার গেট পর্যন্ত গেলেও ক্লাসে হাজির হয়নি– এ বিষয়গুলো দ্য ডিসেন্ট-এর সাথে মায়ের আলাপে উঠে এসেছে যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারের কথা বলতে কালিয়াকৈর থানায় যান এ প্রতিবেদক। ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে থানায় না পেয়ে ফোনে যোগাযোগ কয়া হয়৷ এ সময়

কালিয়াকৈর থানার ওসি আব্দুল মান্নানের কাছে প্রশ্ন ছিল- কোন কিসের ভিত্তিতে আগে দুইবার পালিয়ে যাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ? 

ওসি বলেন, “আমরা তদন্ত করেছি। তারা বাবা-মা স্বীকার করেছেন। স্থানীয় লোকজনও বলেছে। এছাড়া ভিক্টিম ও অভিযুক্তকে মুখোমুখি জিজ্ঞেস করেছি—তারাও বলেছেন।”

“একটা পক্ষ এটাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করছে। যেটা আসলে না” বলেন আব্দুল মান্নান।

 

আইন কী বলছে

অপ্রাপ্তবয়স্ক ভিকটিম (১৩ বছর বয়সী) যদি নিজ সম্মতিতে অভিযুক্তের সাথে যেয়েও থাকেন এবং নিজের সম্মতিতে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন তাহলে আইনের দৃষ্টিতে তা কীভাবে বিবেচিত হবে-- বিষয়টি বুঝতে দ্য ডিসেন্ট কথা বলেছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান (এ্যানী) এর সাথে।

তিনি বলেন, ”কেউ যদি আন্ডার এইজ (১৮ এর নিচে) কারো সাথে তার সম্মতিতেও শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় তাহলেও সেটি আইনের দৃষ্টিতে ‘ধর্ষণ’ বলে বিবেচিত হবে।”

“বাংলাদেশী আইনে তো ও শিশু। ওকে তো চকোলেট বা এমনকিছু দিয়ে প্রলুব্ধ করা যায়। ওর তখন ওই মেন্টাল গ্রোথটা হয় না।”

 

(প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর কয়েকটি তথ্য ও বক্তব্য যুক্ত ও আপডেট করা হয়েছে)