
বিশ্বের বিভিন্ন খনি থেকে যে পরিমাণ সোনা তোলা হয়েছে, তার প্রায় ১৭ শতাংশ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনার রিজার্ভ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৩৭ হাজার টনের বেশি। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় সোনার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ইতিহাসে কখনো এর আগে এত বেশি সোনা কেনেনি। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তারা মোট ৩ হাজার ২০০ টন সোনা কিনেছে। অনিশ্চয়তার কারণে চীন, রাশিয়া, ভারত, তুরস্ক, পোল্যান্ড ও কাজাখস্তানের মতো দেশগুলো এখন ডলারনির্ভর রিজার্ভ থেকে সরে গিয়ে সোনায় আস্থা রাখছে। ফলে বাড়ছে সোনার দাম। দেখে নেওয়া যাক, সোনা রিজার্ভের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনগুলো।
১
যুক্তরাষ্ট্র, সোনার মজুত: ৮ হাজার ১৩৩ টন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনার ভান্ডারের মালিক যুক্তরাষ্ট্র। এই সোনার বড় অংশ রাখা আছে ডিপ স্টোরেজ বা গভীর সংরক্ষণাগারে—ডেনভার, ফোর্ট নক্স ও ওয়েস্ট পয়েন্টে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের ভাষায়, সরকারের মালিকানাধীন সোনা মজুত হলো ডিপ স্টোরেজ। টাকশালের সিল করা ভল্টে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এই সোনা সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিবছর ট্রেজারির ইন্সপেক্টর জেনারেলের দপ্তর এসব ভল্ট পরিদর্শন করে। এই মজুতের বেশির ভাগই সোনার বার আকারে সংরক্ষিত থাকে। বাকি সোনা থাকে চলতি মজুত হিসেবে। কংগ্রেসের অনুমোদিত সোনার কয়েন তৈরি করার কাঁচামাল হিসেবে টাকশাল এই সোনা ব্যবহার করে।
২
জার্মানি, সোনার মজুত: ৩ হাজার ৩৫০ টন
জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্দেস ব্যাংকের অর্ধেকের বেশি মজুত রাখা আছে বিদেশে—নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ফ্রান্সে। ২০১২ সালে সোনার নিরীক্ষা নিয়ে সমালোচনার পর জার্মানি সোনা দেশে ফিরিয়ে আনে; ২০১৬ সালের মধ্যে ৫৮৩ টন সোনা দেশে ফিরিয়ে আনে তারা। বর্তমানে তাদের প্রায় অর্ধেক সোনা ফ্রাঙ্কফুর্টে, এক-তৃতীয়াংশ নিউইয়র্কে, এক-অষ্টমাংশ লন্ডনে এবং সামান্য কিছু প্যারিসে সংরক্ষিত। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের পর জার্মানি সোনা ফেরত আনার পরিকল্পনা আরও জোরদার করে।
৩
ইতালি, সোনার মজুত: ২ হাজার ৪৫২ টন
ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক দ্য ইতালিয়া ১৮৯৩ সালে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূত করার পর থেকে সোনা জমাতে শুরু করে। প্রথমে তাদের হাতে ছিল মাত্র ৭৮ টন সোনা। জার্মানির মতো ইতালিও সোনার একটি অংশ বিদেশে সংরক্ষণ করে। যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে এই সোনা সংরক্ষিত আছে।
৪
ফ্রান্স, সোনার মজুত: ২ হাজার ৪৩৭ টন
ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনার পুরোটা সে দেশেই সংরক্ষিত। এই সোনা রাখা আছে ব্যাংকের বিশেষ ভূগর্ভস্থ ভল্টে, যা লা সুতেরেন নামে পরিচিত। এটি মাটির প্রায় ২৭ মিটার গভীরে অবস্থিত। লা সুতেরেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চারটি অনুমোদিত সোনা সংরক্ষণাগারের একটি।
৫
রাশিয়া, সোনার মজুত: ২ হাজার ৩৩০ টন
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সোনা দেশেই সংরক্ষণ করে। মস্কোতে দুই-তৃতীয়াংশ এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে এক-তৃতীয়াংশ। বেশির ভাগ সোনা বড় বার আকারের; এগুলোর ওজন ১০ থেকে ১৪ কেজি। রাশিয়ার নিজের মুদ্রা রুবলের মান ২০২২ সালে সোনার সঙ্গে যুক্ত করে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে লন্ডন মার্কেটে রাশিয়ার সোনার বিক্রি বন্ধ এবং প্রায় অর্ধেক সোনা জব্দ করা হয়েছে।
৬
চীন, সোনার মজুত: ২ হাজার ২৯৯ টন
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংকের মজুত সোনার অধিকাংশ ২০০০ সালের পর কেনা হয়েছে। পিপলস ব্যাংক ১৯৮২ সালে পান্ডা সোনার কয়েন চালু করে। এটি এখন বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি সোনার কয়েনের একটি। ২০২৪ সালে তারা আরও ৪৪ মেট্রিক টন সোনা কিনেছে। প্রায় প্রতি মাসেই সোনা কেনে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
৭
সুইজারল্যান্ড, সোনার মজুত: ১ হাজার ৪০ টন
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের হাতে মজুত সোনা সুইজারল্যান্ডের সরকারের মালিকানাধীন, যদিও তা পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মজুতের সোনা কোথায় রাখা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে দেশটিতে। এমনকি সব সোনা দেশেই মজুত রাখা হবে কি না, তা নিয়ে গণভোটও হয়েছে। সেই গণভোটে মানুষ ‘না’বোধক রায় দিলেও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও স্বচ্ছ হতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ৭০ শতাংশ সোনা সুইজারল্যান্ডে, ২০ শতাংশ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে ও ১০ শতাংশ ব্যাংক অব কানাডায় সংরক্ষিত।
৮
ভারত, সোনার মজুত: ৮৮০ টন
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সোনা মজুতে বেশ তৎপর। ২০১৭ থেকে কেনা শুরু হলেও মূলত গত চার বছরে বিপুল পরিমাণ সোনা কেনা হয়েছে। ২০২৩ সালে ১৬ টন এবং ২০২৪ সালে আরও ৭২ মেট্রিক টন সোনা কেনা হয়। তার সোনার অর্ধেকের বেশি বিদেশে এবং এক-তৃতীয়াংশ সে দেশেই সংরক্ষিত। ২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্য থেকে ১০০ টন সোনা দেশে ফিরিয়ে আনে ভারত। ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম তারা এ কাজ করল।
৯
জাপান, সোনার মজুত: ৮৪৬ টন
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক অব জাপানের সোনার মজুত সম্পর্কে প্রকাশ্য তথ্য পাওয়া কঠিন। ২০০০ সালে দেশটির হাতে প্রায় ৭৫৩ টন সোনা ছিল। ২০০৪ সালে এটি বেড়ে ৭৬৫ দশমিক ২ টনে পৌঁছায় এবং মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সেই স্তরে থাকে। তখন দেশটি আরও ৮০ দশমিক ৭৬ টন সোনা কেনে।
১০
তুরস্ক, সোনার মজুত: ৬৩৫ টন
তুরস্কের সোনার মজুত ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১১ টনের মতো বেড়েছে। ২০০০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে তুরস্কের সোনার মজুত গড় ছিল ২৭১ দশমিক ৬১ টন। সর্বোচ্চ মজুত ছিল ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৬৩৪ দশমিক ৭৬ টন; সর্বনিম্ন ২০০১ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১১৬ দশমিক ০৪ টন।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল, ট্রেডিং ইকোনমিকস, ইনভেস্টিং নিউজ নেটওয়ার্ক
শীর্ষনিউজ