
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী প্রশাসনের দাপটবিহীন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলের ভরাডুবির পরে সারাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক ভুলগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে জয় পেতে মরিয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতারা। একই সঙ্গে চিন্তা রয়েছে আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলকে সুগঠিত করার।
এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন উঠেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ছাত্রদলের মধ্যেও। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ইকসু) সামনে রেখে দ্রুতই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের নতুন কমিটি হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সংগঠনের গতিশীলতা ফেরাতে নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে এবারের কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে।
২০২১ সালের ১৬ জুন লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের সাহেদ আহম্মেদকে আহ্বায়ক ও ইংরেজি বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের মাসুদ রুমী মিথুনকে সদস্যসচিব করে করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। সেই কমিটির বয়স এখন প্রায় সাড়ে ৪ বছর। কমিটি ঘোষণার পরপরই সংবাদ সম্মেলন করে পদ পাওয়া ১২ জন সদস্য দলীয় নীতিমালা না মেনে বিবাহিত, অছাত্রদের পদ দেয়ার অভিযোগ তুলে কমিটি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হয়। তবে একাংশের বিরোধিতার মুখে কমিটি টিকে গেলেও সাংগঠনিক কার্যক্রমে দেখা যায় স্থবিরতা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন সময় নেতাদের মধ্যে বিভক্তি এবং একাংশের নিষ্ক্রিয়তা সাংগঠনিক কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। বয়সের দিক দিয়ে অনেক সিনিয়র নেতাদের হাতে কমিটির নেতৃত্ব থাকায় সংগঠনের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গেছে। কমিটির অধিকাংশ সদস্য নিষ্ক্রিয়, বিবাহিত ও চাকরিজীবী। দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতারা দলীয় পদ আঁকড়ে থাকায় ক্যাম্পাসে কার্যক্রমে ধীরগতি রয়েছে। ফলে সংগঠনের গতিশীলতা ফেরাতে নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবছেন তারা।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদলের ডাকসু ও জাকসুকেন্দ্রিক বিপর্যয় এবং সার্বিক বিষয়ে আপডেট ও জবাবদিহিতা নিতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একাধিক ভার্চুয়াল সভা করেছেন। সেখানে সার্বিক আলোচনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক অবস্থা, শক্তিমত্তা, বিভাজন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের কার্যক্রম সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছেন তিনি৷ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব সাংগঠনিক অবস্থা শক্তিশালী করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
এদিকে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে পরাজয়ের পরে নতুন কমিটি দেওয়া হবে- এমন আশায় কমিটির ডজনখানেক পদপ্রত্যাশী বিভিন্নভাবে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই নিজেদের সিভি বা বায়োডাটা প্রস্তুত করে নিজেদের কর্মযজ্ঞ সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে ধরে নিজেকে যোগ্য প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী কাজের মাধ্যমেও কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন অনেকে। পাশাপাশি ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যেয়ে অথবা কেন্দ্রীয় কোন নেতারা আশপাশের জেলায় সফরে এলে সেখানে গিয়ে নেতাদের প্রটোকল দিচ্ছেন অনেকে। দলের দুর্দিনে কীভাবে তারা ভূমিকা রেখেছেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় থেকেছেন, সেসবও তুলে ধরছেন অনেকে। তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদেরই শীর্ষপদে দেখতে চায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
আলোচনায় থাকা পদপ্রত্যাশী তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে বর্তমান কমিটির নেতারাসহ বেশ কয়েকজনের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে৷ তাদের মধ্যে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রাফিজ আহমেদ (ফিন্যান্স ২০১৮-১৯), নুর উদ্দিন (ফলিত রসায়ন ২০১৮-১৯), কমিটির বাইরের সক্রিয় কর্মী আবু সাইদ রনি (রাষ্ট্রবিজ্ঞান ২০১৭-১৮), রাকিব হাসান স্বাক্ষর (অ্যাকাউন্টটিং ২০১৮-১৯), তরিকুল ইসলাম সৌরভ (মার্কেটিং ১৮-১৯) রিফাত হোসাইন (টুরিজম ১৯-২০), বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইবির সাবেক সহ-সমন্বয়ক তৌহিদুল ইসলাম (অ্যাকাউন্টটিং ১৯-২০), আরিফুল ইসলাম জনি (সমাজকল্যাণ ১৯-২০) অন্যতম।
এমতাবস্থায় দলীয় নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বদের দিয়েই ইবি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের একাধিক সূত্র। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে তারুণ্যের জোয়ার এবং এই জেনারেশনের জেন-জি পালসের কথা বিবেচনায় নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে দলের দুঃসময়ে সিনিয়র নেতাদের ব্যর্থতা, ঐক্যবদ্ধ না থেকে গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে জড়ানো এবং অভ্যুত্থানের পরে লম্বা সময় পেয়েও দলকে সুগঠিত করতে না পারায় শুধু বয়সের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে তাদের হাতে নেতৃত্বের ভার দিতে নারাজ কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।
এ বিষয়ে ইবির কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি জহির রায়হান আহমেদ বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটে কমিটি গঠনের কাজ চলছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নতুন কমিটিও খুব দ্রুতই দিয়ে দেওয়া হবে। এবারের কমিটিতে তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই। শুধু বয়সের দিক দিয়ে সিনিয়র হলেই পদে আনা হবে- এমন ভাবধারা থেকে বেরিয়ে তারুণ্য নির্ভর ছাত্রদল গড়তে চাই আমরা। ইবির কমিটির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। যাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব আছে এবং জেন-জি পালস বুঝে রাজনীতি করতে পারবে তাদেরই কমিটিতে রাখা হবে। একই সঙ্গে দুঃসময়ের ত্যাগ-তিতিক্ষার মূল্যায়ন এবং নিজের ও পরিবারের আত্মীয়স্বজনের দলীয় ব্যাকগ্রাউন্ডও যাচাই-বাছাই করেই পদ দেওয়া হবে।’