
জুলাই সনদে সই না করা এবং স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও না যাওয়ার অবস্থানে অনড় আছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি – এনসিপি। দাবি পূরণ না হওয়ায় এই অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিপি নেতারা বলছেন, আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে কেবল একটি ‘ইনফরমাল সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা অনানুষ্ঠানিক সামজিক চুক্তির জন্য এত আয়োজন ও ত্যাগ-তিতীক্ষার প্রয়োজন ছিল না।
অন্য কোনো দলের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় ভাবে ধরে রাখার মধ্য দিয়ে মূলত ‘সংস্কার প্রশ্নে স্বকীয়তাই’ রাজনৈতিক পরিসরে জানান দেবে বলে মনে করছে দলটি।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, কৌশল হিসেবে এই অবস্থান এনসিপির জন্য ভালো নাও হতে পারে। আবার কারও কারও মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে ‘যৌক্তিক’ অবস্থানই নিয়েছে দলটি।
অবশ্য শেষ মুহূর্তেও অনড় অবস্থান থেকে দলটির সরে আসার সুযোগ আছে–– এমনটাও ভাবছেন অনেকে। ঐকমত্য কমিশনও সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো এতে স্বাক্ষর না করলে সনদের কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয়ে এনসিপির আপত্তি
সংস্কারের বিষয়ে মাসের পর মাস রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর খসড়া চূড়ান্ত করা হয় এবং ১৫ই অক্টোবর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ঘোষণা আসে।
পরে তা আরো দুইদিন পিছিয়ে ১৭ই অক্টোবর করা হয়। জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে বিএনপি রাজি থাকলেও, এর আইনি ভিত্তির প্রশ্নে অবস্থান নেয় জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদে স্বাক্ষর আয়োজনে আসার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। তবে এখনো অনড় অবস্থানে আছে এনসিপি।
এ নিয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াঁজো প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, আইনি ভিত্তি ও ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ জারির আগেই দলগুলোর স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করছে। অথচ আদেশে কী থাকবে, কবে হবে, কে করবেন সেটি না জেনে স্বাক্ষর করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’
এর আগে, জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতেও সোচ্চার ছিল এনসিপি।
গত বছর ডিসেম্বরে নিজেরাই তা প্রকাশের ঘোষণা দেন। নানা নাটকীয়তার পর গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিন প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সেই প্রসঙ্গ টেনে আদীব বলেন, আইনি ভিত্তির আগে এই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো আরেকটি এক পাক্ষিক দলিলে রূপান্তরিত হবে।
দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলছেন, আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে তা কেবলই একটি ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ হবে যা যে কেউ, যেকোনো সময় ব্রিচ (লঙ্ঘন) করতে পারে)।
একইসাথে এনসিপির এই অবস্থান থেকে রাজনৈতিক পরিসরে বার্তা যাবে যে বিএনপি বা জামায়াতের ‘স্ট্যান্ড’ দেখে এনসিপি কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেয় না।
এর মাধ্যমে সংস্কার নিয়ে নিজস্ব বোঝাপড়া দলটির ‘স্বকীয়তাকেই’ তুলে ধরছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ঐকমত্য কমিশন সময় বৃদ্ধি করায় কমিশনের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে এনসিপি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে এবং দাবি পূরণ হলে পরবর্তী সময়ে সনদে স্বাক্ষর করবে বলেও জানিয়েছে দলটি।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাঙন ধরার শঙ্কা
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই সনদের খসড়া, গণভোট এবং সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তিন দফা দাবির কথা জানান, যেগুলো পূরণ না হলে এনসিপি সনদে সই করবে না বলে জানানো হয়। শুক্রবার সকালেও দলটিকে একই অবস্থানে দেখা গেছে।
তবে জুলাই সনদ নিয়ে এই কৌশল দলটির জন্য হিতকর হবে না বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ।
তার মতে, রাজনৈতিকভাবে দলটি এরইমধ্যে ৯০ শতাংশ অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে। এবার সনদে সই না করলে দলটির প্রাসঙ্গিকতা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।
সাব্বির আহমেদ বলেন, এটা বাস্তবায়ন করার জন্য কারও ওপর কোনো বাইন্ডিংস (বাধ্যবাধকতা) থাকবে না। মেইন স্টেকহোল্ডারদের (মূল অংশীদার) মধ্যে যদি কেউ সাইন না করে, তাহলে এই সাইনিংয়ের গুরুত্ব একেবারেই কমে যাবে। সেক্ষেত্রে সনদে সই করে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের দিকে এগোতে পারে ।
অন্যদিকে ‘আইনি ভিত্তির’ প্রসঙ্গে এনসিপির অবস্থানকে যৌক্তিক বলেই মনে করছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, আমরা যদি প্রচলিত সংবিধানের আলোকে দেখি, তাইলে এটার পেছনে যুক্তি আছে। আর এটার জন্য চাপ দিচ্ছে।
প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে তা ‘সিটিজেন চার্টার’ হবে না বলে মন্তব্য করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সেক্ষেত্রে তিনি অতীতের তিন জোটের রূপরেখার উদাহরণ টেনে বলেন, নেতারা কেউ সই দেয়নি। কাজেই এটার কোনো বাইন্ডিং ছিল না তাদের ওপরে।
তবে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখন অব্দি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে সহিষ্ণুতা দেখা গেছে, জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে তাতে যদি ফাটল ধরে, তা আসন্ন নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠে খুব সুখকর কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।