
২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে টানা তিনদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আন্দোলন করলেও সমাধান দিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর্থিক বিষয় হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বিদেশে থাকায় এ বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাড়িভাড়া পান ১০০০, আর চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা
দেশের ৩০ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবমিলিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এরমধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রায় সাড়ে তিন লাখ, আর কর্মচারী দেড় লাখেরও বেশি। বিরাট সংখ্যক এ শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়িভাড়া বাবদ মাসে মাত্র এক হাজার টাকা আর চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৫০০ টাকা! এই দুই ভাতা ও উৎসব ভাতা (বোনাস) বাড়ানোর দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। তবে কোনো সমাধান দিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সবশেষ গত আগস্টে শিক্ষকরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো শতাংশ হারে বাড়িভাড়ার দাবি তোলেন। মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা দেওয়ার দাবি জানান তারা। তাদের দাবি উপেক্ষা করে গত ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসে মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। যা যৌক্তিক নয় বলে বলে দাবি তুলেছেন শিক্ষকরা।
এরপর পূর্বঘোষণা অনুযায়ী রোববার (১২ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সারাদেশ থেকে আসা কয়েক হাজার শিক্ষক অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। এদিন দুপুরে তাদের ডাক পড়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সেখানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পাওয়ায় শিক্ষকরা ফিরে এসে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
এরমধ্যেই প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। রাস্তায় ফেলে শিক্ষকদের লাঠিপেটা করা হয়। গুরুতর আহত হন তিনজন। আটক হন ছয়জন। এ ঘটনায় আরও ফুঁসে ওঠেন শিক্ষকরা।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) থেকে সারা দেশের সব বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দেন। পাশাপাশি শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান তারা।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ‘মার্চ টু সচিবালয়’ শুরু করেন শিক্ষকরা। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হাইকোর্ট মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ শিক্ষক–কর্মচারীদের আটকে দেয়। সেখানেই সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। এ অবস্থান কর্মসূচি থেকে অনশনের হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষক নেতারা।
অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্যকালে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘আজ আমরা এখানে (হাইকোর্টের সামনে) অবস্থান করবো, আগামীকাল বেলা ১১টার মধ্যে যদি আমাদের দাবি না মানেন, আমরা শাহবাগে অবস্থান নেব। তারপরও যদি দাবি না মানা হয়, আমরা যমুনায় যাব। এরপরও দাবি পূরণ না হলে আমরা আমরণ অনশনে বসবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই। কারণ, আন্দোলন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সরকারকে আমাদের দাবি মানতেই হবে এবং এটি আর এখন বাস্তবায়ন না করার সুযোগ নেই। যতক্ষণ দাবি না মানবেন, ততক্ষণ আমরা সচিবালয় ঘেরাও করে রাখবো।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে চেয়ে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ইস্যুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অর্থ বিভাগে পাঠানো এক আধা-সরকারি চিঠিতে উৎসব ভাতা ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ৫ অক্টোবর অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা উৎসব ভাতা বাবদ মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা মাসিক ৫০০ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া মাসিক ১,০০০ টাকা হারে পাচ্ছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষক-কর্মচারীরা নির্দিষ্ট টাকার পরিবর্তে মূল বেতনের অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য আর্থিক প্রভাবের একটি প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে।
প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া ভাতা ২০ শতাংশ (ন্যূনতম ৩,০০০ টাকা) হারে দিলে ব্যয় হবে প্রায় ৩,৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ (ন্যূনতম ২,০০০ টাকা) হারে দিলে ২,৪৩৯ কোটি টাকা, ১০ শতাংশ হারে দিলে ১,৭৬৯ কোটি টাকা এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে ১,৩৭১ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারের আর্থিক সামর্থ্যের আলোকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বাড়ি ভাড়াভাতা মূল বেতনের শতকরা হারে নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের নম্বরে কল দিলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকদের দাবির ইস্যুগুলো পুরোপুরি আর্থিক। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত লাগবে।
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবরও শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশে নেই অর্থ উপদেষ্টা-সচিব, সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না কেউ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন গেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। উপদেষ্টার নেতৃত্বে ১২ সদস্যের সফরকারী দলে রয়েছেন অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারও। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা ১৩ অক্টোবর শুরু হয়েছে, যা চলবে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকদের বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব দুজনই দেশের বাইরে। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষানীতি গবেষক ও অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকদের এই আন্দোলন আসলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যয় ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার কাঠামোগত দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা খাতকে আমরা সর্বদা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলি, কিন্তু বাজেট বণ্টনের সময় সেটিই সবচেয়ে কম গুরুত্ব পায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বাজেটে যে বরাদ্দ থাকে, তার বড় অংশই প্রশাসনিক খাতে চলে যায়—শিক্ষক কল্যাণ বা মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে নয়। ফলে শিক্ষকরা ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন।
তিনি আরও বলেন, সরকার চাইলে এ মুহূর্তে সব দাবি পূরণ করতে না পারলেও একটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা দিতে পারে। এতে শিক্ষক সমাজ আশ্বস্ত হবে এবং অচলাবস্থাও কেটে যাবে। এখন যদি শুধু সময়ক্ষেপণ বা প্রশাসনিক দোহাই দিয়ে বিষয়টি ফেলে রাখা হয়, তাহলে তা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রাষ্ট্রের আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে শিক্ষকদের প্রাপ্য নিশ্চিত করা সম্ভব—এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও পরিকল্পিত নীতি। সরকার যদি শিক্ষাখাতে ব্যয়ের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাস করে, তবে এই সংকট কেবল সমাধানই হবে না, বরং শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকেও এটি একটি বড় পদক্ষেপ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই তো রাষ্ট্রের এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করে। স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থার হাল হকিকত দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। শিক্ষকদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম যে সুবিধাটুকু প্রয়োজন, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
ড. রওনক খানের মতে, শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, শিক্ষকদের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত না করলে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা অবাস্তব। শিক্ষকদের জীবিকা টিকে থাকলে শিক্ষার মানও টিকে থাকবে
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু পাঠ্যক্রম তৈরি নয়, বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য টেকসই শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করা। শিক্ষাব্যবস্থায় উদাসীনতা শুধু নীতির স্তরে নয়, বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপেই দৃশ্যমান। এই মানসিকতা না বদলালে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।
তিনি বলেন, শিক্ষকরা যে দাবি করছেন সেটা নায্য। অবশ্যই এ দাবি মেনে নিয়ে একটি টেকসই সমাধান করা উচিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিক্ষকদের এই আন্দোলন কোনো তাৎক্ষণিক ক্ষোভ নয়, বরং এটা দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বৈষম্যের ফল। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাখাতকে জাতীয় অগ্রাধিকারের জায়গায় রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে দেখা যায়, এই খাতটি বরাবরই প্রান্তিক অবস্থায় পড়ে আছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি মোটেও অযৌক্তিক নয়। বরং বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় এই দাবিগুলো বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র তার শিক্ষক সমাজের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে, তা আসলে শিক্ষার প্রতি সামগ্রিক উদাসীনতার প্রতিফলন। শিক্ষকরা কেবল বেতনভোগী নন, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের কারিগর। অথচ তাদের মৌলিক প্রাপ্য নিশ্চিত না করে বারবার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রথাগত উদাসীনতা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত দুর্বল করে দিচ্ছে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা। এখনই সময় শিক্ষকদের সঙ্গে আন্তরিক সংলাপের। দোষারোপ বা সময়ক্ষেপণ নয়, প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত। অন্যথায় শিক্ষাঙ্গণের এই অচলাবস্থা শুধু শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো জাতির জন্যই ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষাখাতে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা মানে জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করা।