
কুমিল্লা শহরে একসময় আতঙ্কের নাম ছিল সাবেক এমপি আ.ক.ম বাহার উদ্দিন বাহার। চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মাধ্যমে নগরী নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তবে, এখন বাহারের সেই অধ্যায় শেষ হলেও চাঁদাবাজির নতুন রূপ কুমিল্লায়। শুধু হাতবদল হয়েছে। একচেটিয়া ভবন নির্মাণসামগ্রী বিক্রির নামে নতুন রূপে চলছে চাঁদাবাজি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন ভবন নির্মাণ করার জন্য চাঁদাবাজ চক্রের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্মাণপণ্য কিনতে হয়। অর্থাৎ ইট, বালু, সিমেন্ট, পাইলিং, থাই গ্লাস, রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রিসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চাঁদাবাজদের হাতে। ভবন নির্মাণসামগ্রী এবং সব কাজের মিস্ত্রি সরবরাহ করছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। এলাকাভিত্তিক এক একজন এসব পণ্য সরবরাহ করে এসব খাত থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছেন তারা। নগরীর তেলিকোনা, মুন্সেফ বাড়ি, মুরাদপুর এলাকায় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীরা স্থানীয় বিএনপি’র নেতাদের কাছে অভিযোগ জানালেও তারা এর কোনো সুরাহা করেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাখাওয়াত উল্লাহ সিফন, রাজিউর রহমান, রাজিব, ইসরাফুল উল্লাহ বিশাল ও মাহবুব কুমিল্লা নগরীর ইপিজেড ও কুমিল্লা মেডিকেল এলাকার নির্মাণ সামগ্রীর চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া রেসকোর্স এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করে আবু বকর সিদ্দিক। তাদের অনুমতি ছাড়া এসব এলাকায় অন্য কেউ রড, সিমেন্ট, বালু এবং বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করতে পারে না। এ অভিনব পদ্ধতি ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় এমন অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। ওদিকে শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে রেজাউল কাইয়ুম নামে একজন এবং পদুয়ার বাজার বাসস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে মাহবুবসহ বেশ কয়েকজন। তারা বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে।
সৌদি প্রবাসী ইকরাম জমি কিনেছিলেন ইপিজেড এলাকায়। ৩ মাস আগে বাড়ির কাজ শুরু করলে কিছু ছেলে এসে তাকে বলেন- তাদের দেখানো দোকান থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনতে হবে। না হলে পাইলিংয়ের কাজ করতে পারবো না। বাধ্য হয়ে তাদের দেখানো দোকান থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনতে হয়েছে। এমনকি তাদের সরবরাহ করা মিস্ত্রিকে দিয়েও কাজ করতে হয়েছে। তারা বেশি টাকা পারিশ্রমিক নিতো। আমার ৫০ লাখের উপরে খরচ হয়েছে বাড়ি করতে। ওদের দেখানো সিমেন্টের দোকান থেকে বাড়তি দাম দিয়ে সিমেন্ট কিনতে হয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের জানিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। প্রশাসনের উচিত এসব ধান্দাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
আরেক ভুক্তভোগী রাকিব হোসেন বলেন, আমার ভাই দেশের বাইরে থাকেন। সে রেসকোর্স এলাকায় বাড়ির কাজ শুরু করলে কিছু ছেলে এসে কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা তাদের দেখিয়ে দেয়া দোকান থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনতে বলেন। কিন্তু সেখানে দাম অত্যধিক বেশি ছিল। পরে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধান করেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, গত কয়েক মাস আগে নগরীর মুন্সেফ বাড়ি এলাকায় বাড়ি করতে গেলে কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সারের নাম ভাঙিয়ে কিছু ছেলে এসে বলে নির্মাণসামগ্রী সব ওদের পরিচিত দোকান থেকে নিতে হবে। এই এলাকায় অন্য কেউ আর এসব পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। পরবর্তীতে আমরা নিজাম উদ্দিন কায়সারকে জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি। উল্টো তিনি বলেছেন- এসব পণ্য যেহেতু লাগবেই তাই ওদের কাছ থেকে নিতে। আমরা হামলার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারি না।
স্বস্তিতে অটোচালকরা: ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে নগরীর অটোরিকশা চালকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। আগে অটোরিকশাচালকদের চার স্থানে চাঁদা দিতে হলেও বর্তমানে এক স্থানে চাঁদা দিতে হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, স্বস্তিতে যাত্রী আনা-নেয়া করছেন অটোরিকশাচালকরা। অভিযোগ ছিল, সাবেক এমপি বাহারের ঘনিষ্ঠরা নগরীর শাসনগাছা, পুলিশ লাইন, কান্দিরপাড়, টমছম ব্রিজ থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের থেকে প্রতি স্থানে ১০ টাকা করে আদায় করতো। বর্তমানে অটোরিকশা চালকদের শুধু শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে ১০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। তবে টমছম ব্রিজে অটোচালকদের টাকা গুনতে না হলেও সিএনজি চালকদের টাকা দিতে হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টমছম ব্রিজে আলম নামে একজন কেরানি সিএনজি চালকদের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। এ ছাড়া শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করে রেজাউল কাইয়ুম নামে একজন।
ফুটপাথে চাঁদাবাজি: এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও বন্ধ হয়নি ফুটপাথ থেকে চাঁদাবাজি। টমছম ব্রিজ ও কান্দিরপাড় এলাকায় রাস্তার ওপর প্রায় শতাধিক দোকান বসে। অবৈধ দোকানের কারণে জ্যাম লেগে থাকে নগরীতে। এসব দোকান থেকে দৈনিক ২০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। টমছম ব্রিজ এলাকায় চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন রাজিব খান। তিনি শুধু চাঁদা না- এ এলাকার ছিনতাই চক্রেরও মূলহোতা বলে জানা যায়।
টমছম ব্রিজের দোকানদার আবুল হোসেন বলেন, প্রতিদিন ২০০ টাকা করে চাঁদা দেই। না দিলে দোকান উঠিয়ে দেয়। এরা অনেক প্রভাবশালী; প্রশাসনের অনেক লোকজনও এদের সঙ্গে জড়িত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলেন, টমছম ব্রিজ এলাকায় এসব চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মূল হোতা রাজিব খান। সে প্রশাসনের সহযোগিতায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এদের টাকার অংশ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন পায়।
আরেক দোকানদার আলী বলেন, ৩ বছর ধরে কান্দিরপাড় এলাকায় দোকানদারি করি। আগেও ২০০ করে টাকা দিতাম, এখনো ২০০ করে দিতে হচ্ছে। আগে যারা চাঁদা আদায় করতো তারা এখন পালিয়ে গিয়েছে এখন আরেকদলের লোকজন চাঁদা আদায় করছে, টাকা না দিলে দোকান চালাতে পারবো না। গরিব মানুষ টাকা থাকলে তো দোকান নিতাম; ফুটপাথে বসে থাকতাম না।
চাঁদাবাজির বিষয়ে কুমিল্লা মহানগর বিএনপি’র সভাপতি উদবাতুল বারী আবু বলেন, যারা এসব করছে তারা নেশাখোর, টোকাই। এদের কেউ বিএনপি’র সঙ্গে জড়িত নয়। দলের কারও বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। দলের কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে, আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি।